দখিনের সময় রিপোর্ট
‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ হিসেবে ব্যবহার করা হয় স্কোপোলামিন নামে একটি ড্রাগ। স্কোপোলামিন মানুষের নাকের তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চির কাছাকাছি আসলেই নিঃশ্বাসের আওতায় আসে। এটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকলে ১০ মিনিট বা তারও কম সময়ে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মেমোরি এবং ব্রেন তখন সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। স্কোপোলামিন মূলত পাউডার হিসেবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। অপরাধের ক্ষেত্রে এই ড্রাগ কাগজ, কাপড়, হাত এমনকি মোবাইলের স্ক্রিনে লাগিয়েও এর ঘ্রাণ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য যে কারো মানসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া সম্ভব। স্কোপোলামিন ব্যবহার করে প্রতারণার খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই। যার প্রকোপ ক্রমাগত বাড়ছে। স্কোপোলামিন মূলত একটি সিনথেটিক ড্রাগ। এই ড্রাগ তরল এবং পাউডার দুই ধরনেই পাওয়া যায়।
স্কোপোলামিন প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে ‘ট্রুথ সেরাম’ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ এটা যদি ইনজেক্ট করে দেয়া হয় তাহলে সে সত্য কথা বলতে শুরু করে। কারণ তার মগজের উপর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যখন স্কোপোলামিন কথা বলানোর জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ট্রুথ সেরাম। যখন পাউডার ফর্মে নিঃশ্বাসের জন্য ব্যবহার করা হয় তখন এটা ‘ডেভিলস ব্রেথ’, মানে শয়তানের নিঃশ্বাস। আর যখন এটা বমি অথবা মোশন সিকনেসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন তখন এটা আসলে ওষুধ।
একসময় মানুষকে পাগল করে দেয়ার জন্য দুধের মধ্যে ধুতরা বেটে খাওয়ানো হতো। ধুতরা ফুল কিন্তু একটা বিষ। ঐ ধুতরা থেকে উপাদান নিয়ে সিনথেটিক্যালি এটা বানানো হয়েছে। মেক্সিকোর মাদক চক্র এই মাদকটা বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। স্কোপোলামিন মূলত পাউডার হিসেবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, কাপড় কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে এটি লাগিয়ে কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তিদের নিঃশ্বাসের কাছাকাছি আনা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা জানিয়েছেন, স্কোপোলামিন প্রভাব শুরু হলে মেমোরি আর ব্রেন সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। এর প্রভাব কাটিয়ে কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে অন্তত এক ঘণ্টা সময় লাগে। আবার কেউ তিন/চার ঘণ্টা অস্বাভাবিক থাকেন। প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এর মূল উপাদান আসে ধুতরা ফল থেকে।
এদিকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, ওষুধ হিসেবে স্কোপোলামিনের ব্যবহার এখনও আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার করা হয়। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী রোগীর জন্য ওষুধে এর ব্যবহার আছে। স্কোপোলামিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে ব্যবহারের নজির আছে। তখন এর ব্যবহার হতো লিকুইড হিসেবে, ইনজেকশনের মাধ্যমে। এটা এবং এর মতো আরো বেশ কিছু ওষুধ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়।
স্কোপোলামিন নামের ড্রাগের ব্যবহারের বিষযটি পুলিশ প্রথম জানতে পারে ২০২৩ সালে। নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেই হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে আরো একজনকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে একজনের কাছে প্রথমবারের মতো স্কোপোলামিন পায় পুলিশ। বোতলের ভেতর সাদা পাউডার আকারে কয়েক গ্রাম স্কোপোলামিনসহ আরো কয়েক ধরনের মাদক জব্দ করা হয়। পরে আদালতের আদেশ নিয়ে সিআইডি’র ল্যাবে টেস্ট করার পর সেখানে স্কোপোলামিন শনাক্ত হয়। স্কোপোলামিন নিয়ে পর্যালোচনা করে পুলিশ জানতে পারে, এটাকে আসলে ‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ বলে অনেকে। এই ড্রাগ কুরিয়ারের মাধ্যমে এবং বিভিন্নভাবে চোরাকারবারিরা দেশে আনছে।
শুরুতে ঢাকায় পাওয়া গেলেও দ্রুত স্কোপোলামিন ব্যবহার করে সারা দেশেই প্রতারণা ছড়িয়েগেছে। যদিও এমন ঘটনার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে মাদক কারবারীরা স্কোপোলামিন আনছে সেটিও একটা বড় প্রশ্ন।
তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা