• ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যৌথ বিবৃতি নিয়ে  কিছু দলের আপত্তি, সংকট কতটা দূর হয়েছে?

দখিনের সময়
প্রকাশিত জুন ১৫, ২০২৫, ১৮:১১ অপরাহ্ণ
যৌথ বিবৃতি নিয়ে  কিছু দলের আপত্তি, সংকট কতটা দূর হয়েছে?
সংবাদটি শেয়ার করুন...
দখিনের সময় ডেস্ক:
প্রধান উপদেষ্টার ড. ইউনূস ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর আপাতদৃষ্টিতে  ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট উত্তরণ’ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু কার্যত সংকট কতটা দূর হয়েছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে রাজনৈতিক মহলে। রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক জটিলতা এখনো কাটেনি, বরং সামনের সময়ে ‘রাজনৈতিক মেরূকরণ আরও জটিল’ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এক্ষেত্রে সব পক্ষকে ধৈর্য ধরে ছাড় দিয়ে হলেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নির্বাচন সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে হবে কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করছেন।
দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের ভিন্নমত নেই। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের সমঝোতায় তারা অখুশিও নন। বরং সরকার কেন শুধু বিএনপির সঙ্গে বৈঠক শেষে বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয়ে যৌথ বিবৃতি দিল, সেটি নিয়ে তাদের প্রশ্ন। এ ধরনের ঘটনাকে তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে মনে করেন। এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার এবং সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কেননা, নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব হচ্ছে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করা। শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা তার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বার্তা পৌঁছে দেয়। সরকার এভাবে একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দিতে পারে কি না এবং সেটি কতটা নৈতিক, তা নিয়ে যদি কিন্তু থেকেই যায়।
জামায়াতে ইসলামী
লন্ডনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক প্রসঙ্গে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি মনে করে, প্রধান উপদেষ্টা গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। তার ওই ঘোষণার পর লন্ডন সফরকালে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে যৌথ বিবৃতি প্রদান করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয়। এর মাধ্যমে তিনি (ড. ইউনূস) একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে। আমরা মনে করি, দেশে ফিরে এসে প্রধান উপদেষ্টার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে তার অভিমত প্রকাশ করাই সমীচীন ছিল। গতকাল শনিবার সকালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে এমন অভিমত ব্যক্ত করা হয় বলে দলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দুপুরে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দলীয় প্রতিক্রিয়া জানায় জামায়াতে ইসলামী।
ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী আন্দোলনের অভিমত প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠককে সাধুবাদ জানালেও যৌথ বিবৃতি নিয়ে আপত্তি তুলেছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা আতাউর রহমান বলেন, শুক্রবারের(১৩ জুন) বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ডিসেম্বর থেকে সরে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টাও শর্তসাপেক্ষে তা বিবেচনার কথা বলেছেন। নিজস্ব অবস্থানকে যৌক্তিক কারণে পুনর্বিবেচনা করার এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তবে শীর্ষ দুই নেতার বৈঠকের পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে সরকারের উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের শব্দ প্রয়োগকে বিস্ময়কর আখ্যা দিয়ে আতাউর রহমান বলেন, ড. ইউনূস বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। তারেক রহমান একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। এ কথা সত্য, তারেক রহমান দেশের রাজনীতির একক প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাদের বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হলেও আক্ষরিক অর্থে এটা দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে একজন রাজনৈতিক নেতার সংলাপ; কিন্তু প্রেস ব্রিফিংয়ে বার বার ‘যৌথ বিবৃতি’ বলা বিস্ময়কর। একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের ‘যৌথ বিবৃতি’ প্রদান শোভনীয় না।
জাতীয় নাগরিক পার্টি
ইউনূস-তারেক বৈঠকে সংস্কার ও বিচার গুরুত্ব না পাওয়ায় হতাশ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ-সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি বলে মনে করে এনসিপি। বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’ বলেছে দলটি। শুক্রবার(১৩ জুন) রাতে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত পাঠানো এক বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি; কিন্তু বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ-সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি। বিবৃতিতে আরও বলা হয়- নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণঅভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন-আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে। জনগণের দাবি তথা জুলাই সনদ রচনা ও কার্যকর করার আগে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে, তা জনগণ মেনে নেবে না। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে এনসিপি।
খেলাফত মজলিস
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আপত্তি লন্ডনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক প্রসঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক, সিনিয়র নায়েবে আমির ইউসুফ আশরাফ এবং মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ শনিবার( ১৪ ‍জুন) এক বিবৃতিতে বলেন, যে কোনো গঠনমূলক সংলাপ ও আলাপ-আলোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার(১৩ জুন) তারেক রহমান ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নির্বাচনকালীন প্রক্রিয়া, বিচারিক অগ্রগতি ও কাঙ্ক্ষিত সংস্কার নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তা নীতিগতভাবে সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে নেতৃবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব হচ্ছে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করা। তাই কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা তার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বার্তা পৌঁছে দেয়। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামীতে আরও সতর্ক ও ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিএনপির জবাব
বিএনপির মন্তব্য লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ‘একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন’ বলে জামায়াতে ইসলামী যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তার জবাব দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি গতকাল কালবেলাকে বলেন, শুধু বিএনপি নয়, দেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের দাবি ছিল রোজা, আবহাওয়া ও এইচএসসি পরীক্ষার কারণে এপ্রিলে নির্বাচন সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো দলের প্রতি অনুরাগ নয়; বরং ২০২৬ সালের রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হতে পারে বলে জামায়াতের আমির যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেটার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত নির্বাচনের নতুন সময়সীমা সামঞ্জস্যপূর্ণ। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এই বৈঠক নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতেই বলা আছে যে জামায়াতের আমির গত ১৬ এপ্রিল একটি বিদেশি মিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ২০২৬ সালের রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হতে পারে বলে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। ফলে লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে যে ঘোষণা, তা জামায়াতের আমিরের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নতুন রাজনৈতিক দলটি (এনসিপি) লন্ডন বৈঠকের ঘোষণাকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। এ ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টির ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তাদের আরও অভিজ্ঞতা অর্জনের পরামর্শ থাকবে।