নিষ্ঠুর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সফল কারীগর ছাত্ররা আপতত সামনে থেকে নতুন রাজনৈতিক গঠনের উদ্যোগটি বাতের থেকে জাহেরে এসেছে। এ নিয়ে নানান ধরনের অভিমত আছে। কারো মতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি দেখা হয়েছে; এখন নতুন একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হলে মন্দ হয় না। অবশ্য এদেরই একটি অংশ মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দৃঢ় বলয় ভেদ করে নতুন একটি রাজনৈতিক দল দাঁড় করানো মোটেই সহজসাধ্য নয়। কিন্তু সবচেয়ে মজার কথাটি বলছেন বিএনপি। তারেক রহমানের কেরিসমেটিক নেত্বত্বে পরিচালিত রাজনীতির মাঠে প্রধান এই দলটি ছাত্রদের নতুন দল গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘তা যেনো কিংস পার্টি না হয়!’ কিন্তু ইতিহাস বলে, বিএনপির জন্ম হয়েছে কিংসপার্টি হিসেবে। একটি প্রবচন আছে, ‘ভুতের মুকে রাম নাম।’
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী শাসনের লেজেগোবরে অবস্থা, বিশৃংখলা, লুটপাট, দুর্ভিক্ষ এবং আরো নানান কারণে ঘটে ১৯৭৫ সালের নৃশংস ১৫ আগস্ট। সফল হয় ৭৫-এর থিংক ট্যাংক। এরপর নানান ঘটনা প্রবাহের পর ৭ নভেম্বর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান। প্রথমে তিনি ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির পদে সমাসীন হন। রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমের উত্তরসূরি হিসেবে জিয়াউর রহমান ২১শে এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করে মসনদে জেকে বসেন।
এরপর ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও জয়লাভ করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। রেকর্ড বলে, তিনি গণভোটেও হ্যাঁ-সূচক ভোটে ‘বিপুল বিজয়’ লাভ করেছিলেন। বিএনপি গঠন করার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। পরে এই দল বিলুপ্ত হয়ে বিএনপিতে যুক্ত হয়।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রচারের মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাম, ডান ও মধ্যপন্থীসহ সকল স্তরের লোককে এক ছাতার নীচে সমবেত করার বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছেন। অনেকেটা একই ঘাটে বাঘ-মহিষকে জল খাওয়ানোর মতো।
জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপির প্রায় ৪৫ শতাংশ সদস্য ছিলেন তরুণ ও রাজনীতিতে নবাগত। পাশাপাশি এদের মাথার উপর রাখা হয়েছে প্রবীন ও অভিজ্ঞদের। জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে কিংস পার্টি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে, আওয়ামী লীগ কেবল ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ‘খুচরা আওয়ামী লীগ’ ২টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া জাসদ ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গড়া কিংস পার্টি হলেও রিাজনীতির দীর্ঘ পথ চলায় গণমানুষের একপ্রকার ভরসার স্থলে পরিণত হয়েছে বিএনপি। এবং এ দলটি পিছনে ফেলে আসতে পেরেছে কিংস পার্টির জন্মকালীন ক্লেদ। এবং তারেদ রহমানের দূরদর্শী নেত্বের কারনে বিএনপি রাজনীতিতে ইনক্রিডেবল হাল্ক-এ পরিনত হয়েছে।
আর এক কিংস পার্টির সফল কারিগর জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাষ নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো শুরু থেকেই। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রহস্যজনকভাবে নিহত হবার পর দ্রুত কয়েক ধাপ পেরিয়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে হটিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ঐ দিন তিনি দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীকে হটিয়ে কাছ থেকে নিজের কব্জায় নেন। ১৯৮৬ সালে তিনি কিংস পার্টি হিসেবে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এরশাদ পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি ‘নির্বাচিত’ হন। এ নির্বাচনে এক ডজন প্রার্থীর মধ্যে গোপালভারের মতো বিভিন্ন ভারামীর কারণে সিলেটের সুক্কু মিয়া ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। সেই নির্বাচনও ছিলো জেনারেল এরশাদের পূর্বসুরী জেনারেল জিয়ার নির্বাচনের আদলেই।
উল্লেখ্য, কিংস পার্টি হিসেবে জাতীয় পার্টি গঠনের আগে এডভোকেট মাহবুবুর রহমানকে শিখন্ডি করে জেনালের এরশাদ ১৮ দফা বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেছিলেন। তার আয়োজিত ১৯৮৬ সালে তামাশার সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। কিন্তু বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালে ৭ ডিসেম্বর তিনি এই সংসদ বাতিল করতে বাধ্য হন। এরপর ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন সকল দল বয়কট করে। এ অবস্থায় ‘অসমের কলরব’ হিসেবে পরিচিত আ স ম রবের নেতৃত্বে কতিপয় আগাছা দল নির্বাচনী তামাশায় সামিল হয়। কিন্তু এতে এরশাদের শেষ রক্ষা হয়নি। বিরোধী দলগুলোর সম্মিলিত আন্দোলন এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনের অভাবে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন জেনারেল এরশাদ।
ক্ষমতা হারানোর কিছুদিন পর জেনারেল এরশাদ গ্রেফতার হন এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন। বলা হয়, নানান ইসুতে আপোষ করেই জেনালের এরশাদ কারামুক্ত হতে পেরেছিলেন। তবে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলায় ফাঁসির দড়ির আতংক থেকে মুক্ত হতে পারেনি জেনারেল এরশাদ। ফলে তিনি আমৃত্যু আপোষ করেই কাটিয়েছেন। এই আপোষ প্রবনতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি রক্ত ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার জি এম কাদেরও। এর সঙ্গে অতি সুবিধাবাদ এবং আরো অনেক কারণ যুক্ত হয়ে কিংস পার্টি হিসেবে গঠিত জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি দ্রুত মুসলিম লীগের পরিণতির ধারায় হাটছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।