• ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় ছিল ‘রং হেডেড জাজমেন্ট’

দখিনের সময়
প্রকাশিত অক্টোবর ২২, ২০২৫, ০৮:২৪ পূর্বাহ্ণ
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় ছিল ‘রং হেডেড জাজমেন্ট’
সংবাদটি শেয়ার করুন...
দখিনের সময় ডেস্ক:
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বিচারপতি খায়রুল হকসহ চার বিচারপতির দেওয়া রায়কে ‘রং হেডেড জাজমেন্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী। এ ছাড়া এ রায় সংবিধানের মূল কাঠামোকে (বেসিক স্ট্রাকচারকে) আঘাত করেনি; বরং মূল কাঠামোকে শক্তিশালী করেছে বলেও মন্তব্য করেছেন। এ ব্যবস্থা বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার(২১ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে প্রথম দিনের মতো আপিলের শুনানিতে অংশ নিয়ে আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া এসব মন্তব্য করেন। আজ বুধবার(২২ অক্টোবর) সকালে ফের এ আপিলের ওপর শুনানি শুরু হবে।
এ রায় দিতে গিয়ে সব ক্ষেত্রে আদালত ভুল করেছেন উল্লেখ করে আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, উনারা সাংবিধানিক ব্যাখ্যার নিয়মনীতি মেনে রায় দেননি, উনারা দেশের বাস্তবতাও বিবেচনায় নেননি। উনাদের রায়ের ফলে দেশ যে গণতন্ত্রহীন হয়ে পড়বে, দেশে স্বৈরতন্ত্র চালু হবে এবং এক-দেড় হাজার মানুষকে জীবন দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে হবে—এগুলো কোনোটাই তারা বুঝতে পারেননি। একটি সাংবিধানিক আদালত হিসেবে এগুলো বিবেচনায় নিয়ে রায় দেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সেটা বিবেচনায় না নিয়েই ভুল রায় দিয়েছেন। উনারা আইন বুঝতে ও প্রয়োগ করতে ভুল করেছেন এ রায়ের মাধ্যমে।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১০ মে বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে চার বিচারপতি এ ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে থাকলেও বেঞ্চের বাকি তিন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। এ ছাড়া রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। কিন্তু সে পর্যবেক্ষণ উপেক্ষা করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সংবিধান সংশোধন করে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ করে। এ ব্যবস্থা বিলোপ করে রাতের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকে আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আপিল বিভাগের সেই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে পৃথক পাঁচটি রিভিউ আবেদন করা হয়। পরে আপিল বিভাগ রিভিউ মঞ্জুর করে বিষয়টি আপিল আকারে শুনানির নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী গতকাল শুনানি হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের চাপে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। ওই বছর ২৭ মার্চ সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে। এরপর এই পদ্ধতির অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে আইনজীবী এম সলিমউল্যাহসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। শুনানির পর তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।
পরে রিট আবেদনকারীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১০ সালে আপিলে শুনানি শুরু হয়। সর্বোচ্চ আদালত এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে দেশের আটজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন। তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি সে সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তখনকার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতি শুনানি গ্রহণ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেন। এ ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে ছিলেন বিচারপতি খায়রুল হকসহ চারজন। আর তিনজন ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠের দেওয়া রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অর্থাৎ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অগণতান্ত্রিক এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে তা বাতিলযোগ্য। তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই রায় ঘোষণার সাত দিন পর অর্থাৎ ১৭ মে অবসরে যান এ বি এম খায়রুল হক। অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে ‘তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে’। এই পর্যবেক্ষণ বাদ দেওয়া হয়। পরে এই পূর্ণাঙ্গ রায়কে আশ্রয় করে দলীয় সরকারের অধীনে পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকেন শেখ হাসিনা। জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট তার পতন ঘটে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ২৭ আগস্ট ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে (রিভিউ) আপিল বিভাগে আবেদন করেন বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। এরপর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় বাতিল চেয়ে গত ১৭ অক্টোবর আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীও। এ ছাড়া আরও দুটি আবেদন করা হয়। পাঁচবার এ আবেদনগুলোর শুনানি পেছানোর পর মঙ্গলবার প্রথম দিনের শুনানি হয়।