Home জাতীয় ঘাতকরা দ্বিতীয় বার খুজঁতে আসে আবুল হাসানাতকে, শাহান আরা বেগমের শরীরে বুলেট...

ঘাতকরা দ্বিতীয় বার খুজঁতে আসে আবুল হাসানাতকে, শাহান আরা বেগমের শরীরে বুলেট ছিলো আমৃত্যু

আলম রায়হান ॥
খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ১৫ আগস্টের খুনীচক্র রেহাই দেয়নি শিশু এবং অন্তঃসত্তা নারীকেও। সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শিশু রাসেল খুন হয়েছেন। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে ঘাতকের বুলেটে নিহত হয়েছেন শিশু সুকান্ত বাবু। বিদেশে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে গেছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এদিকে দেশে থেকেও রমনা থানার তৎকালীন ওসির বুদ্ধি মত্তায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ।
খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে খুনীচক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি প্রায় একই সময় হত্যালীলা চালায় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে। ৩২ নম্বরের বাড়ীর মতো বঙ্গবন্ধুর দুই স্বজনের বাড়িতেও চলে নির্বিচারে নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা।
মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে ঘাতকরা সকলকে নীচতলার এক রুমে লাইনে দাঁড় করায়। খুনীরা বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, বাড়িতে আর কেউ আছে কিনা। এ সময় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছিলেন দোতলায়। বিশিষ্ট নাট্যজন সৈয়দ দুলাল দৈনিক দখিনের সময়কে জানিয়েছেন, খুনীদের বারবার জেরার মুখে সাহান আরা বেগম বিব্রত হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, কী বলবেন। এ সময় লাইনে থাকা রব সেরনিয়াবাতের দিকে তাকান। তিনি নেতিবাচক ইসারা করেন। এদিকে শিশু সুকান্ত বাবু মায়ের কোলে ওঠার জন্য কাঁদছিলো। কিন্তু তখন সাহানারা বেগমের কোলে ১৭ মাস বয়সী সাদিক আবদুল্লাহ। এ অবস্থায় শহীদ সেনিয়াবাত শিশু সুকান্ত বাবুকে কোলে তুলে নেন। শহীদ সেনিয়াবাতকেই আবুুল হাসানাত আবদুল্লাহ ভেবে সকলের উপর মুহুর্তে ব্রাশ ফায়ার করে ঘাতক দল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! সেদিন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ছাড়াও ঐ বাড়িতে নিহত হন শহীদ সেরিয়াবাত, বেগম আরজুমনি, বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাদ ও সুকান্ত বাবু।
সৈয়দ দুলাল দৈনিক দখিনের সময়কে জানান, গোলাগুলির শব্দে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ নিচে নেমে আসেন। ততক্ষণে সেখানে অনেক লাশ এবং কিছু আহত মানুষ। তিনি হাসপাতালে প্রেরণের কাজ শুরু করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত হন রমনা থানার তৎকালীন ওসি। বিচক্ষন এই পুলিশ অফিসার আবুুল হাসানাত আবদুল্লাহকে বলেন, “স্যার আপনি এখান থেকে এখনই চলে যান। হাসপাতালে পাঠানের কাজ আমি করছি।” এই বলে অনেকটা জোর করে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে বাড়ি থেকে বের করে দেন রমনা থানার ওসি। এর কয়েক মুহুর্ত পরই ঘাতক দল আবার ছুটে আসে। সেদিন পুলিশ কর্মকর্তা বিচক্ষণতার পরিচয় না দিলে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহও সেদিন নিহত হতেন।
এদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে ১৯৯০ সালে রাজধানীর কলাবাগানের সে সময়ে ভাড়া বাড়িতে অবস্থানকারী শাহান আরা বেগম এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এক পর্যায়ে বাষ্পরূদ্ধ কন্ঠে বলেন, “আমি কেমন মা, মৃত্যু পথযাত্রী শিশু পুত্র সুকান্তকে স্পর্শ করতে পারিনি!” এরপর তিনি বলেন, আমরা সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছি। কারো মৃত্যু হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে, কেউ মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করছে। পুরো রুম ভেসেগেছে রক্তে। একাধিক বুলেট বিদ্ধ হয়ে আমি লাশের মধ্যে পড়ে ছিলাম। জানি না কীভাবে বেঁচেগেছি!
১৫ আগস্ট একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে গেলেও সারাজীবন বুলেটের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে শাহান আরা বেগমকে। ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেট কেবল নয়, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে ঘাতকের বুলেট তাড়া করেছে বহু বছর আগে থেকেই। বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকালে তাঁকে লক্ষ করে ভবনে গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। গাড়িতে যাবার সময় সদর রোডে তাঁর গাড়িতে গুলি করেছে অজ্ঞাত ঘাতকরা। প্রতিবারই অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ।
এদিকে আমৃত্যু শাহান আরা বেগম তাঁর শরীরে ১৫ আগস্টের বুলেট ধারণ করে অবর্ননীয় যন্ত্রনা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। সময় মতো চিকিৎসা না হবার কারণে এই বুলেট পরে শরীর থেকে আর বের করার অবস্থায় ছিলো না। হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা নিয়ে নিদারুণ এক চিত্র এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেছিলেন শাহান আরা বেগম। তিনি জানান, ‘সেরনিয়াবাত পরিবারের সাথে পরিচিত ঝালকাঠির সৈয়দ আনোয়ার হোসেন হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসার জন্য ৫শ’ টাকা দিয়েছিলেন, আবার কিছুক্ষণ পর এসে টাকা ফেরত নিয়ে গেছেন।’
উল্লেখ্য, ঝালকাঠির এই সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এলাকায় আনোয়ার মীর নামে পরিচিত। ১৫ আগস্টের পর তিনি খুনী মোশতাকের খুব কাছের লোক হয়ে গিয়েছিলেন। অথবা আগে থেকেই যোগাযোগ ছিলো। এখন বয়সের হিসেবে ৯০ বছর পেরিয়ে গিয়েও এখনো বেঁচে আছেন এই সৈয়দ আনোয়ার ওরফে আনোয়ার মীর। সারা জীবনে তার নানান রকমের প্রতারণা ও ভন্ডামীর ঘটনা আছে। এমনকি তিনি পবিত্র কাবাঘর নিয়েও ভন্ডামী করেছেন। একবার পবিত্র হজ পালন শেষে দেশে ফিরে খন্দকার মোশতাককে বলেছেন, “স্যার আল্লাহর ঘরের সামনে দুই হাত তুলে যখন মোনজাত তুললাম তখন এক হাতে আপনার ছবি, অন্য হাতে আমার বাবার ছবি দেখলাম।”
এই সৈয়দ আনোয়ার ৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাপ করে বিফল হয়েছেন। সেই সময়ে মনোনয়ন পাবার আশায় বহু টাকা গচ্ছা যাবার বেদনা তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। এই কষ্ট নিয়েই তিনি একাধিক বার সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এবং প্রতিবারই জামানত হারিয়েছেন। একবার তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে লাঙ্গল প্রতীক নিয়েও সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেবারও প্রাপ্ত ভোট তার জামানত রক্ষা করতে পারেনি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

কঠিন বাস্তবতায় বিএনপি

বাঁচতে হলে পানি পান করতেই হবে। এটি সব প্রাণীর জন্য সত্য। জীবজগৎ পানিনির্ভর। পানি ছাড়া পৃথিবী অচল। পানির প্রয়োজন সবার। তবে এ প্রয়োজনের মাত্রা...

মানবিক মুখোশের আড়ালে দানব মিল্টন, অসহায় মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি

দখিনের সময় ডেস্ক: মানবিক মুখোশের আড়ালে নানা অপকর্মের অভিযোগে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।...

চীনে অ্যাপ স্টোর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ সরিয়ে নিল অ্যাপল

দখিনের সময় ডেস্ক: মার্কিন টেক জায়ান্ট অ্যাপল সম্প্রতি তাদের নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড সাইট অ্যাপ স্টোর থেকে মেটার মালিকানাধীন দুটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপ এবং থ্রেডস অ্যাপ...

ফ্রিতে এআই ব্যবহার করে ছবি-ভিডিও এডিট করবেন যেভাবে

দখিনের সময় ডেস্ক: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি বেশ দাপটের সাথে রাজত্ব করেছে প্রযুক্তিবিশ্বে। যেকোনো জায়গায় যেকোনো কাজে মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে এই...

Recent Comments