Home অন্যান্য ফেসবুক কর্ণার প্রত্যাশায় হতাশার সুনামী

প্রত্যাশায় হতাশার সুনামী

দখিনের সময় ডেস্ক:

“বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সার্বিক কল্যাণের প্রত্যাশা নিয়ে গত ১৫.০৪.১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ হতে প্রত্যাশা সমবায় সমিতি লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এ সমিতির সদস্য সংখ্যা ৩৮১ জন। সমিতির সদস্যদের সীমিত আয় থেকে অর্জিত অর্থে প্রত্যেকের বাসা/বাড়ি করার মত এক খণ্ড জমির নিশ্চয়তার লক্ষ্যে প্রত্যাশা সমবায় সমিতির গৃহায়ণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়”।

মো. নজরুল ইসলাম

জেলা প্রশাসক, গাজীপুর

ও সভাপতি,

প্রত্যাশা সমবায় সমিতি লিঃ

রথখোলা, জয়দেবপুর

গাজীপুর।

২৪ চৈত্র ১৪০৩ বঙ্গাব্দ

৭ এপ্রিল ১৯৯৭ খ্রিঃ

(২) সমিতিটির প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভায় (অএগ) প্রকাশিত কার্যপত্রে সভাপতি’র বক্তব্য থেকে ওপরের তিনটি বাক্য তুলে ধরা হলো। ‘প্রত্যাশা সমবায় সমিতি’র মূল উদ্দেশ্য (ড়নলবপঃরাব) বোঝার জন্য  উদ্ধৃত তৃতীয় বাক্যটিই যথেষ্ট বলে মনে আমি করি। অথচ এর পরে দীর্ঘ ২৭ বছরের পথ পরিক্রমা। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে নিরন্তর আসা যাওয়ার পাঁচালি। ঋতু বৈচিত্রের সাথে সাথে আমাদের প্রত্যাশাও দ্বিগুণ-ত্রিগুণ বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে আমাদের অসংখ্য মেধাবী সদস্য রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণীতে পদাধিকারী হয়েছি। কাজ করারও অন্তহীন সুযোগ হাতে ছিল বা এখনো আছে। তবুও আমরা কী এ স্বপ্ন নিয়ে একচুল পরিমাণ এগুতে পেরেছি? বহুবছর ধরে পথচারীরা দেখছে, সরকারি দায়িত্ব পালনকারী এতগুলো পদস্থ মানুষের সম্মিলিত স্বপ্নও মরে যেতে পারে! এবং সিদ্ধান্তহীনতার অদৃশ্য পর্বতের নিচে চাপা পড়ে স্বপ্নগুলো অশ্রু হয়ে ঝরতে পারে! এতকাল পরে এ কৈফিয়ত কে কার কাছে চাইবে?

 (৩) সদ্য অবসরপ্রাপ্ত জীবনের আজকের এ সময়ে উপনীত হয়ে এ সমিতি সম্পর্কে ভাবতে গেলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তথা একজন মানুষ হিসেবে আমার নিজের অপরাধই মুখ্য হয়ে ওঠে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাত্র কয়েক’শ টাকার বেতন থেকে বলা যায়, স্ত্রী ও সন্তানদের বঞ্চিত করে এ সমিতির কিস্তি পরিশোধ করার কথা মনে হলে আমি হতচকিত, বিস্মিত ও বিমূঢ় হই। আজও  আশ্চর্য লাগে, যথাযথভাবে অবহিত না হওয়ায় এবং পার্বত্য জেলায় পদায়ণ থাকায় আমাকে একাধিকবার সুদসহ এর কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছিল। তখন মনে হত, যাক ঢাকার অদূরে একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই তো হচ্ছে! আমাদের সন্তানদেরও নিজস্ব একটি ঠিকানা থাকবে। এমন সহজ প্রাপ্তি ক’জনের ভাগ্যে হয়!

(৪) এদিকে প্রতিদিনই সরলপ্রাণ, স্বপ্নবান ও মহৎ উদ্যোক্তা মানুষগুলো একে একে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই ৫১ জন প্রিয় সদস্য মৃত্যু বরণ করেছেন। অপূর্ণ অধরাই থেকে গেল তাদের প্রত্যাশার ছোট্ট ভুবন। তারা দেখে যেতে পারেননি বা বাস করে যেতে পারেননি নিজের জমির ওপর নির্মিত ঘরে। যেমন দেখে যেতে পারেননি আমার স্ত্রী জেবু। জুন ২০২০ সালে করোনায় তার অকাল মৃত্যু হয়। মনে পড়ে, বিগত ১৯৯৮ সাল থেকে অন্তত পঞ্চাশবার তাকে নিয়ে সমিতির প্রকল্প এলাকায় গিয়েছি। এমনকি চিহ্নিত প্লটের মাটিতে বেড়ে ওঠা ঘাসে নগ্নপায়ে হেঁটে হেঁটে সে কত-না কল্পনার জাল বুনেছিল। এখান থেকে কিশোরগঞ্জের পথ কোনটা হবে? ঢাকায় গেলে সারাদিন কাটিয়ে আসবো, আর বিমানবন্দর তো ২০ মিনিটের ব্যাপার ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ আমার এসবের মূল্য কে দেবে? এতে কার-ই বা কী আসে যায়? আর এখন আমার নিজেরই বা কত আগ্রহ অবশিষ্ট আছে?

(৫) আমাদের দেশের সর্বশেষ আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ‘প্রত্যাশা সমবায় সমিতি’ সিদ্ধান্তহীনতা বা বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণীর ক্ষেত্রে মন্থরগতি বা ধীরচল নীতির দিক থেকে শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে। বছর বছর সাধারণ সভা হলেও সিদ্ধান্তহীনতার এমন নৈরাজ্যের রেকর্ড অদূর ভবিষ্যতে অন্য কোন লিমিটেড সমিতি বা সংগঠন অতিক্রম করে যেতে পারবে বলে আমরা কেউ বিশ্বাস করি না। এদিক থেকে সম্মানিত সদস্যগণ একটা সান্ত্বনা পেতে পারেন যে, পরবর্তী প্রজন্ম ‘প্রত্যাশাকে’ দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করে তাদের কাজে অনেক সাফল্য পাবে। তবে তারা অবশ্যই আমাদেরকে ভর্ৎসনাসহ অভিশাপ দেবে এই বলে যে, ‘যারা নিজেদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক দায়িত্ব পালনে ঐক্যবদ্ধ এবং ঐকমত্যে পৌঁছতে প্রায় তিন দশক সময় নিয়েও কিনারা করতে পারছেন না, তারা দেশ ও জাতির জন্য কীভাবে কি করেছেন! তা নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে’।

(৬) গত ক’বছরে দেশব্যাপী হাউজিং বা ডেভলপার কোম্পানির সম্প্রসারণ হয়েছে অকল্পনীয় হারে। এগুলোর মাশরুম বিস্তার ঘটেছে উপজেলা ও ছোট ছোট পৌর এলাকা পর্যন্ত। তারা রাস্তার পাশে জমি পেলেই প্রকল্প নিচ্ছে। অথচ প্রত্যাশার জন্য উত্তরা সংলগ্ন হাইওয়ে থেকে সংযোগ ব্রিজ করা হয়েছে তা কমপক্ষে দশ বছর আগে। আমরা ডেভলপারের সন্ধান পাই না। নিজের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত জমির মূল দলিল জমা রাখা হয়েছে তা-ও কয়েক বছর হলো। এতে মনে হয়, সমিতির সদস্যদের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছি, প্রতিটা এজিএমে তর্ক-বির্তক এবং  বিচিত্রসব পরামর্শ, মান-অভিমান, আশা-নিরাশার কল্পনাবিলাসী মতামত উদগীরণ করে দিনের শেষে শূন্য হাতে আরও একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়ি ফেরা। মনে হয়, এটি এখন প্রত্যাশার ললাটের অমোচনীয় বেদনার ক্ষত চিহ্ন।

(৭) দেশের সকল পেশাজীবী সংগঠনই অন্তত নিজেদের জন্য পারে এবং পেরেছে। কেউ কেউ অনন্য নজির স্থাপনও করেছে। আমাদের না পারার পেছনের প্রচ্ছন্ন রহস্য খুঁজতে গেলে পাওয়া যায়-

প্রথমত, আমরা সবাই বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিমান। কখনও হেরে যাওয়ায় অভ্যস্ত নই বরং গোটা জীবন কেবল জিতে যাওয়ার গল্পে ভরপুর। বেশি বুদ্ধিমান মানুষের সমাবেশ থেকে কোনও বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত পাওয়ার সুযোগ কম।

দ্বিতীয়ত, আমরা সবাই বলি ‘অল্পে তুষ্ট মানুষ আমি’।  বাস্তবে আমরা অনেক বেশি বেশি করে চাই। ফলে প্রত্যেকের জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছি অনেক উৎকৃষ্ট সময়।

তৃতীয়ত, আস্থা, অনাস্থার দ্বন্দ্ব এবং অন্যের ওপর শতভাগ আস্থা রাখার পূর্ব অভিজ্ঞতার সংকট। আমরা কেউ ভাবি না, “মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ”।

(৮) এ ক্ষেত্রে বলা যায়, শতভাগ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে পৃথিবীতে কোনওকালেই সামষ্টিক কল্যাণে বড় কিছু হয়নি। কাজেই কতিপয় মানুষের হাতেই এর ভার ছেড়ে দিতে হবে। প্রয়াত লেখক ও সাহিত্যেক আহমদ ছফা বলেছেন, “১৯৭১ সালের পূর্বে বঙ্গবন্ধু যদি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনতেন, তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না”। কাজেই এতেও কম শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই। তাছাড়া,“বেশি বুদ্ধিমান মানুষেরা কখনও ভালো মানুষ হয় না। আর ভালো মানুষেরা সবসময় কম বুদ্ধিমান”।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

আজ বোমা ফাটাবেন বেনজীর, সকাল সাড়ে ১১টার অপেক্ষা

​​​​​​​দখিনের সময় ডেস্ক: সম্পদের পাহাড় গড়ার খবরে টক অফ দ্যা কান্ট্রি হয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। আজ বোমা ফাটাবেন। ‍এ জন্য তিনি সময়...

বিদেশে চিকিৎসা নিরুৎসাহিত করতে হবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

দখিনের সময় ডেস্ক: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, বিদেশে চিকিৎসা নিরুৎসাহিত করতে হবে। সেজন্য তিনি দেশে চিকিৎসকদের আরো বেশি সেবার মনোভাবী হওয়ার অনুরোধ জানান।...

তীব্র গরমে ছয় বিভাগে স্বস্তির খবর

দখিনের সময় ডেস্ক: দেশজুড়ে গরমের হাঁসফাঁস পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আজ শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেওয়া পূর্বাভাসে...

সারা দেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট

দখিনের সময় ডেস্ক: দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহের তীব্রতা বাড়তে পারে এবং অব্যাহত থাকতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে ৩ দিনের জন্য সতর্কতামূলক হিট অ্যালার্ট...

Recent Comments