প্রায় আড়াই মাস হতে চলল বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা একটি সামরিক বিমানে চেপে দিল্লিতে এসে অবতরণ করেছিলেন। তারপর থেকে তাকে আর এক মুহূর্তের জন্যও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি, সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার কোনও ছবি ‘লিক’ হয়নি, নানা কথিত ফোনালাপের অডিও ফাঁস হলেও সেগুলো যে তারই কণ্ঠস্বর তারও কোনও প্রমাণ মেলেনি।
ভারতে এসে নামার পর থেকে তিনি যেন কার্যত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন!
তিনি (বা তার সঙ্গে আসা ছোট বোন শেখ রেহানা) দিল্লিতে নামার পর থেকে কীভাবে আছেন, কোথায় আছেন তা নিয়ে ভারত সরকারের মুখপাত্র, মন্ত্রী বা নীতি-নির্ধারকরা আজ পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেননি। কোনও সাংবাদিক সম্মেলনেও না, কোনও সাক্ষাৎকারেও না।
তবে ভারত সরকার বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে ও পরোক্ষে এটুকু শুধু জানিয়েছে যে তিনি এখনও ভারতেই অবস্থান করছেন। গত সপ্তাহে বিবিসি বাংলা যেমনটা জানিয়েছিল যে শেখ হাসিনার আমিরাত বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে যাওয়ার খবর সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, ফলে সেটুকু অন্তত এখন ভারত সরকারও অফিশিয়ালি ‘কনফার্ম’ করছে।
শেখ হাসিনার এ দেশে থাকা নিয়ে ভারত সরকার সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখতে সফল হয়েছে এটা যেমন ঠিক, তাকে কতদিন ভারতে রাখতে হবে সে ব্যাপারে দিল্লি কিন্তু এখনও পুরোপুরি অন্ধকারে।
“ইট’স গোয়িং টু বি আ লং হল”, ব্যক্তিগত অভিমত জানাচ্ছেন দিল্লির সাউথ ব্লকের একজন শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা– যার ধারণা, বেশ লম্বা সময়ের জন্যই শেখ হাসিনাকে ভারতে থাকতে দিতে হবে এই বাস্তবতার জন্যই সরকার এখন ক্রমশ প্রস্তুত হচ্ছে।
তাহলে কি অতীতে যেভাবে তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা বা আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর স্ত্রী-সন্তানদের ভারত ‘পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম’ বা রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদক্ষেপের কথা ভাবা হচ্ছে?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে দিল্লিতে বিবিসি বাংলা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তার ভিত্তিতে যে উত্তরটা পাওয়া যাচ্ছে তা মোটামুটি এরকম :
প্রথমত, ভারতের চোখে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা হলেন একজন ‘গেস্ট, বাট আন্ডার কমপালশন!’ অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রের একজন সম্মানিত অতিথি– যাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ভারতে চলে আসতে হয়েছে। নিজ দেশে তার নিরাপত্তা বা সুরক্ষা বিপন্ন হয়ে উঠেছিল বলেই তিনি ভারতে এসেছেন, এটাও ভারত খুব ভালো করেই জানে। এখন এই ‘অতিথি’র স্ট্যাটাসেই তাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এ দেশে রেখে দেওয়া যেতে পারে– ভারতের তাতে কোনও অসুবিধা নেই। দেশের পুরনো বন্ধু ও অতিথি হিসেবে তিনি সব প্রাপ্য সম্মানই পাবেন।
দ্বিতীয়ত, পরে পরিস্থিতি অন্যরকম হলে অন্য কিছু ভাবা যাবে– কিন্তু এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় বা অ্যাসাইলাম দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা ভারতের নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি নিজেও অ্যাসাইলামের জন্য কোনও আবেদন করেননি। কিন্তু যদি সত্যিই পরে সেরকম কোনও প্রস্তাব আসে, ভারত সরকার জানে এ ব্যাপারে দেশের সব দলই একমত হবে এবং শেখ হাসিনাকে অ্যাসাইলাম দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করা কোনও সমস্যাই হবে না। কিন্তু এখনই আগ বাড়িয়ে এরকম কোনও পদক্ষেপ দিল্লি নিতে চাইছে না।
ফলে এক কথায় বলতে গেলে, আপাতত ভারত শেখ হাসিনাকে ‘আতিথেয়তা’ দিতে চাইছে – ‘আশ্রয়’ নয়।
ভারতে হাসিনা : কী জানি, কী জানি না?
১৭ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “আপনারা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে অবস্থান নিয়ে জানেন…তাকে এখানে খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে চলে আসতে হয়েছিল প্রধানত সুরক্ষার কারণে। তিনি এখনও সেভাবেই আছেন।”
এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তিনি এটুকু অন্তত প্রকারান্তরে জানিয়ে দিয়েছেন, শেখ হাসিনা এখনও ভারতেই অবস্থান করছেন। তবে এর পরেও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বহু প্রশ্নের জবাব এখনও অজানাই রয়ে গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, গত আড়াই মাসে শেখ হাসিনার গতিবিধি নিয়ে ঠিক কতটুকু নিশ্চিতভাবে জানা গেছে, আর কোনগুলো নেহাতই জল্পনা বা গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে? বিবিসি বাংলার নিজস্ব অনুসন্ধান বলছে –
এক) গত ৫ই অগাস্ট সন্ধ্যা থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা আগাগোড়া ভারতেই ছিলেন, ভারতেই রয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে, বা আমিরাতের আজমান শহরে পাড়ি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না– তৃতীয় কোনও দেশে যাওয়ার জন্য তিনি বিমানেও চাপেননি। বিমানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে তাকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে, এ খবরও সম্পূর্ণ অসত্য।
দুই) ৫ই অগাস্ট সন্ধ্যায় দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে এসে নামলেও পরবর্তী দু’তিনদিনের মধ্যেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এটাও নিশ্চিত। হিন্ডন মূলত ভারতীয় এয়ারফোর্সের একটি বেস, সেখানে একজন ভিভিআইপি অতিথির লম্বা সময়ের জন্য থাকার কোনও সুব্যবস্থা নেই। কাজেই শেখ হাসিনাকে সেখানে থেকে অন্য লোকেশনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রথম সুযোগেই।
তিন) শেখ হাসিনা যাতে প্রয়োজনে তৃতীয় কোনও দেশে সফর করতে পারেন, এই জন্য ভারত সরকার তাকে ‘ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট’ (টিডি) দিয়েছে– এই মর্মেও সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ভারত সরকার কিন্তু ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে মন্তব্য এড়িয়ে গেছে– বিষয়টি স্বীকার বা অস্বীকার কিছুই করেনি। ফলে শেখ হাসিনা ভারতের কাছ থেকে টিডি পেয়েছেন, এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
চার) শেখ হাসিনা এখনও ভারতেই আছেন, সরকার এটা কনফার্ম করলেও তিনি রাজধানী দিল্লিতেই আছেন কি না– সেটা কিন্তু নিশ্চিত নয়। শেখ হাসিনা ঠিক কোথায় থাকতে পারেন, তা নিয়ে দু’রকম জল্পনা শোনা যাচ্ছে –ক) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দিল্লিতে কর্মরত মেয়ে সাইমা ওয়াজেদের বাসভবনে তার সঙ্গেই শেখ হাসিনাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে আর খ) দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের মীরাট বা হরিয়ানার মানেসরে একটি আধাসামরিক বাহিনীর অতিথিনিবাস বা ‘সেফ হাউসে’ তিনি থাকছেন।
বিবিসি বাংলা আভাস পেয়েছে, এর মধ্যে প্রথমটির কোনও ভিত্তি নেই– কিন্তু দ্বিতীয় জল্পনাটি সত্যি হলেও হতে পারে।
পাঁচ) শেখ হাসিনাকে গত আড়াই মাসের মধ্যে দিল্লির বিখ্যাত লোদি গার্ডেনে মর্নিংওয়াক করতেও দেখা যায়নি, তিনি রাজধানীর কোনও সুপারস্টোরে কেনাকাটাও করতে যাননি। এগুলো শতকরা একশভাগ গুজব– এই সব দাবির স্বপক্ষে কেউ কোনও ছবিও দেখাতে পারেনি, কেউ তাকে ওসব জায়গায় নিজের চোখে দেখেছে এমন দাবি নিয়েও এগিয়ে আসেনি। দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, দিল্লির এই লোদি গার্ডেনে শেখ হাসিনাকে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে বলেও জল্পনা ছিল
ছয়) শেখ হাসিনাকে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে খুবই ‘সেফ’ কোনও লোকেশনে রাখা হয়েছে, তিনি নিজের ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারছেন না– এটা যেমন ঠিক, তাকে ‘গৃহবন্দি’ বা হাউস অ্যারেস্টে রাখা হয়েছে বলাটাও কিন্তু সমীচিন নয়। প্রমাণ হিসেবে বলা চলে, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ফোনের অ্যাকসেস ঠিকই বহাল আছে, আমেরিকা বা দিল্লিতে অবস্থানরত নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গেও তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। এমনকি, দলের যে নেতা-কর্মীদের কাছে তার ব্যক্তিগত টেলিফোন নাম্বার ছিল তারাও অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন এবং কথাবার্তাও বলেছেন।
সাত) তবে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে ভারতে আসতে হয়েছে, তারপর যে কোনও অতিথিকেই কিছু ‘ডিব্রিফিং সেসনে’র মধ্যে দিয়ে যেতে হয়– এবং শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখন তার কাছ থেকে ভারত কী ধরনের ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’ প্রত্যাশা করছে, তার কোনটা বলা উচিত বা কোনটা বলা উচিত নয় বলে মনে করছে– এই সব সেসনে ভারতের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে সে ব্যাপারে ব্রিফ করেছেন এবং তার কাছ থেকেও ‘নোটস’ নিয়েছেন– বিবিসি এটাও নিশ্চিতভাবেই জানতে পেরেছে।
তবে এতসব কিছু ছাপিয়ে দিল্লিতে সদ্যসমাপ্ত দুর্গাপুজোর প্রাঙ্গণে বাঙালিদের আড্ডায় সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা ছিল, শেখ হাসিনা কি এবারে ইলিশের ভরা মরশুমে বাংলাদেশের ইলিশ খেতে পেলেন?
তাকে নিয়ে অন্য অনেক প্রশ্নের মতো এটারও উত্তর রহস্যে মোড়াই থেকে গেছে!
‘বিন বুলায়ে মেহমান’
হিন্দি ভাষায় একটা কথা আছে ‘বিন বুলায়ে মেহমান’– মানে যে অতিথি বিনা আমন্ত্রণেই আপনার ঘরে এসে পৌঁছে যান।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রথম সারির কর্মকর্তা বিবিসিকে বলছিলেন, “শেখ হাসিনাকে বাস্তবিকই হয়তো ‘বিন বুলায়ে’ দিল্লিতে চলে আসতে হয়েছে, কিন্তু তিনি যে আমাদের মেহমান তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই!”
ফলে ভারতের জন্য তার ‘মেহমানদারি’ বা আতিথেয়তায় ঘাটতি রাখারও কোনও অবকাশ নেই।
ভারতের সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়াও মনে করেন, শেখ হাসিনাকে ভারতে থাকতে দেওয়াটা দিল্লির জন্য একটা ‘ডেলিকেট ডিলেমা’ বা খুব স্পর্শকাতর দ্বিধার বিষয় হতে পারে – কিন্তু সত্যি কথা বলতে তাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দেশে রাখা ছাড়া ভারতের সামনে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই!
এদেশের কূটনৈতিক মহলের বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরাও প্রায় সবাই একমত, এই সঙ্কটের মুহূর্তে শেখ হাসিনার পাশে ভারতকে দাঁড়াতেই হবে – কারণ তা না-করলে আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়া বা নেইবারহুডের কোনও দেশের কোনও নেতাই ভারতের বন্ধুত্বে ভরসা রাখতে পারবেন না।
আর সেই পুরনো বন্ধুত্বের মর্যাদা দেওয়ার সবচেয়ে সম্মানজনক রাস্তা হলো, শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির সম্মান দিয়ে যতদিন দরকার, ততদিন ভারতেই রেখে দেওয়া।
দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র সিনিয়র ফেলো স্মৃতি পট্টনায়ক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনা যখন সপরিবার ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন তখনও কিন্তু টেকনিক্যালি তাকে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম দেওয়া হয়নি– বরং পরিচয় গোপন রেখে তাকে রাষ্ট্র একজন অতিথি হিসেবেই রেখেছিল।
সেই সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেই ঘটনার প্রায় অর্ধশতাব্দী বাদে আজকের নরেন্দ্র মোদী সরকারও ঠিক একই রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
তবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত প্রায় ছ’বছর যেভাবে ছদ্মপরিচয়ে ও মিডিয়ার নজর এড়িয়ে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দিল্লিতে রাখা সম্ভব হয়েছিল আজকের যুগে তা সম্ভব নয় সঙ্গত কারণেই!
কিন্তু আতিথেয়তার চরিত্র বদলালেও সেটা কিন্তু আজও আতিথেয়তাই থাকছে, আর অতিথি হিসেবে তাকে রেখে দেওয়াটাই এই কূটনৈতিক সমস্যার আপাতত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান বলেই দিল্লি মনে করছে।
দিল্লিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি যে ভারত ও বাংলাদেশের নতুন সরকারের মধ্যে সম্পর্কে অস্বস্তির উপাদান হয়ে উঠতে পারে, এটা অবশ্য বহু পর্যবেক্ষকই মানেন।
যেমন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির লেখক-গবেষক অবিনাশ পালিওয়ালের মতে, “ভারতেই যদি শেখ হাসিনা থেকে যান তাহলে সেটা হয়তো দু’দেশের সম্পর্কে ডিল-ব্রেকার হবে না, কিন্তু দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিকে তা জটিল তো করবেই!”
“যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অভ্যুত্থান হলো, তিনিই যদি ভারতে আশ্রয় পান তাহলে সেটা দুই দেশের সম্পর্কে অবশ্যই অস্বস্তি বয়ে আনবে এবং সেই লক্ষণ আমরা এর মধ্যে দেখতেও পাচ্ছি,” বলছিলেন ড. পালিওয়াল।
এই জটিল পরিস্থিতিতে ভারত যদি ঘটা করে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে যায়, তাতে অবশ্যই আরও কূটনৈতিক জলঘোলা হবে।
দিল্লি মনে করছে, তার চেয়ে বরং ভালো হবে শেখ হাসিনা এখন ‘যেভাবে আছেন, সেভাবেই থাকুন’– মানে সেটা দেশের অতিথির স্ট্যাটাসে, এবং অবশ্যই যতদিন দরকার।
অ্যাসাইলামের ভালোমন্দ
এত কিছুর পরেও হয়তো আগামী দিনে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় বা অ্যাসাইলাম দেওয়ার কথা ভারতকে বিবেচনা করতে হতে পারে।
অতীতে যেমন তিব্বতের দালাই লামা, মালদ্বীপের মোহামেদ নাশিদ কিংবা আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ-র মতো বিদেশি নেতাদের অনেককেই ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে।
নাজিবুল্লাহ নিজে অবশ্য আশ্রয় পেয়েও ভারতে আসতে পারেননি, কিন্তু তার স্ত্রী-সন্তানরা দিল্লিতে বহু বছর কাটিয়েছিলেন।
হাই-প্রোফাইল কোনও বিদেশি নেতা-নেত্রীকে অ্যাসাইলাম দেওয়া হলে সেটা সাধারণত পার্লামেন্টে ঘোষণা করা হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনাও করা হয় – যদিও তা বাধ্যতামূলক কিছু নয়।
বাঁ দিক থেকে – নেপালের মহারাজা ত্রিভুবন নারায়ণ শাহ, আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ এবং তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা – যারা সকলেই ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেনছবির উৎস,এবঃঃু ওসধমবং
ছবির ক্যাপশান,বাঁ দিক থেকে– নেপালের মহারাজা ত্রিভুবন নারায়ণ শাহ, আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ এবং তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা– যারা সকলেই ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন
দালাই লামার ক্ষেত্রে যেমন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ১৯৫৯ সালে নিজেই পার্লামেন্টে সে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, আর নাজিবুল্লাহর পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার কথা কয়েক বছর পরে পার্লামেন্টে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আই কে গুজরাল।
শেখ হাসিনা প্রথম দফায় (১৯৭৫-৮১) যখন ভারতে ছিলেন, তখন সেটা অবশ্য কাগজে-কলমে ‘অ্যাসাইলাম’ ছিল না– ফলে পার্লামেন্টে তা জানানোরও প্রশ্ন ওঠেনি।
তবে তখন তিনি ছিলেন শুধুই প্রয়াত শেখ মুজিবের কন্যা– আর এখন তিনি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে যিনি প্রায় একুশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন।
ফলে এরকম একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে যদি খুব দীর্ঘ সময় ভারতে রাখার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে ‘অ্যাসাইলাম’ দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে হতে পারে বলে কোনও কোনও পর্যবেক্ষক মনে করছেন।
শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা খুব বড় সুবিধা হলো– ভারতে কোনও রাজনৈতিক দলই সম্ভবত এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে না।
ক্ষমতাসীন বিজেপি ও বিরোধী দল কংগ্রেস, উভয় দলের সঙ্গেই তার সম্পর্ক দারুণ। নরেন্দ্র মোদী কিংবা গান্ধী পরিবারের সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী– এদের সবার সঙ্গেই তার একটা নিজস্ব ‘পার্সোনাল কেমিস্ট্রি’ও গড়ে উঠেছে।
কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিল্লি, ১৯৯৮ছবির উৎস,এবঃঃু ওসধমবং
ছবির ক্যাপশান,কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে শেখ হাসিনা। দিল্লি, ১৯৯৮
দিল্লির জেএনইউ-তে সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলছিলেন, “মনে রাখতে হবে, দালাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তেরও কিন্তু বিরোধিতা করেছিলেন ভারতের কমিউনিস্টরা, যারা তখন চীনের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।”
“কিন্তু শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব এলে ভারতের সব দলই যে তা স্বাগত জানাবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ তিনি যে পরীক্ষিত ভারত-বন্ধু, এটা নিয়ে গোটা দেশেই একটা ‘ব্রড কনসেনসাস’ (সার্বিক ঐকমত্য) আছে।”
শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার আর একটা বড় সুবিধা হলো – তিনি এই স্বীকৃতিটা পেলে তাকে ‘প্রত্যর্পণ’ করার বা বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার যে কোনও অনুরোধ শুধু সেই যুক্তিতেই ফেরানো যাবে।
অর্থাৎ, ভারত যাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে, তিনি নিজ দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন এই আশঙ্কা থেকেই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে– কাজেই তাকে বিচারের জন্য তাদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
আবার এতে অসুবিধার দিকটা হলো, শেখ হাসিনা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও অবধারিতভাবে তিক্ত হবে। বাংলাদেশে একটা শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাবও হয়তো ইন্ধন পাবে।
যেহেতু বর্তমান বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ ও ‘স্টেক’ শত শত কোটি টাকার– তাই দিল্লি সেই ঝুঁকিটা আগ বাড়িয়ে নেবে কি না, সেটাও একটা দেখার বিষয়!
গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং অতঃপর
এই পটভূমিতেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গত ১৭ অক্টোবর ‘ফেরার’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ারা জারি করেছে এবং বাংলাদেশ সরকারও জানিয়েছে, তারা এই নির্দেশ বাস্তবায়নে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।
ঢাকাতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কথা ঘোষণা করছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ছবির উৎস,এবঃঃু ওসধমবং
ছবির ক্যাপশান,ঢাকাতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কথা ঘোষণা করছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম
যদি নির্ধারিত এক মাসের মধ্যে এই পরোয়ানা কার্যকর করতে হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে খুব শিগগিরি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ভারতের কাছে লিখিত দাবিও জানানো হবে।
এই গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ভারত সরকার অবশ্য সে দিনই (১৭ অক্টোবর) কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল শুধু বলেছেন, “আমরাও এসব রিপোর্ট দেখেছি, কিন্তু এগুলো নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।”
তবে এর আগেই দিল্লিতে বহু সাবেক কূটনীতিবিদ ও বিশ্লেষক বিবিসিকে বলেছেন, তারা নিশ্চিত যে দুই দেশের মধ্যেকার প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী যদি শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধও আসে– ভারত কোনোমতেই তা মেনে নেবে না এবং দরকারে হাজারটা যুক্তি দিয়ে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ করবে!
এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় বা অ্যাসাইলাম দেওয়াটাই প্রত্যর্পণের অনুরোধ নাকচ করার একমাত্র রাস্তা নয়– এটার জন্য আরও নানাবিধ উপায় আছে।
অন্যভাবে বললে, শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবেই ভারতে রেখে দিয়েও সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব।
এই কারণেই দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন, শেখ হাসিনাকে টেকনিক্যালি কোন পরিচয়ে বা কোন স্ট্যাটাসে রাখা হলো সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়– বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারত তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য রেখে দিতে প্রস্তুত।
ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাসের কথায়, “উনি গেস্ট হিসেবে থাকলেন, না কি অ্যাসাইলাম পেলেন সেটা কোনও বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, তাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে ভারতেই রাখা হচ্ছে কি না।”
“ইংরেজিতে যেমন বলে না, আ রোজ ইজ আ রোজ! মানে গোলাপকে যে নামেই ডাকো, সে গোলাপই থাকে।”
“ঠিক তেমনি, শেখ হাসিনা ভারতের অ্যাসাইলাম পান বা গেস্ট হিসেবে থাকুন তাতে কিছু আসে যায় না – তিনি ভারতের চোখে শেখ হাসিনাই থাকবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিস গাঙ্গুলি দাস।
ভারতে শেখ হাসিনার এই দফার অভাবিত অবস্থান নিয়ে এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় সত্যি!
দখিনের সময় ডেস্ক:
বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে চীনে যাওয়ার সময় ধর্ষণ মামলার আসামি দুই চীনা নাগরিককে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এরপর...
দখিনের সময় ডেস্ক:
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের...
দখিনের সময় ডেস্ক:
উদ্ভিদ-ভিত্তিক দুধ বর্তমানে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। এটি বাদাম, ওট, নারিকেল বা মটরশুঁটি যাই হোক না কেন, দুধের এই বিকল্পগুলো স্বাস্থ্যকর ডায়েট...
We use cookies on our website to give you the most relevant experience by remembering your preferences and repeat visits. By clicking “Accept”, you consent to the use of ALL the cookies.
This website uses cookies to improve your experience while you navigate through the website. Out of these, the cookies that are categorized as necessary are stored on your browser as they are essential for the working of basic functionalities of the website. We also use third-party cookies that help us analyze and understand how you use this website. These cookies will be stored in your browser only with your consent. You also have the option to opt-out of these cookies. But opting out of some of these cookies may affect your browsing experience.
Necessary cookies are absolutely essential for the website to function properly. These cookies ensure basic functionalities and security features of the website, anonymously.
Cookie
Duration
Description
cookielawinfo-checbox-analytics
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Analytics".
cookielawinfo-checbox-functional
11 months
The cookie is set by GDPR cookie consent to record the user consent for the cookies in the category "Functional".
cookielawinfo-checbox-others
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Other.
cookielawinfo-checkbox-necessary
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookies is used to store the user consent for the cookies in the category "Necessary".
cookielawinfo-checkbox-performance
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Performance".
viewed_cookie_policy
11 months
The cookie is set by the GDPR Cookie Consent plugin and is used to store whether or not user has consented to the use of cookies. It does not store any personal data.
Functional cookies help to perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collect feedbacks, and other third-party features.
Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.
Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.
Advertisement cookies are used to provide visitors with relevant ads and marketing campaigns. These cookies track visitors across websites and collect information to provide customized ads.