• ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লিটন-তুষারের অন্তিম মিল

দখিনের সময়
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ
লিটন-তুষারের অন্তিম মিল
সংবাদটি শেয়ার করুন...
আলম রায়হান:
লিটন বাশারের মগজে সাংবাদিকতার পোকা যখন মৃদু নক করে তখন সে কেবল মেট্রিক পাস করেছে। চাইলে বিষয়টি আবদুর গাফফার চৌধুরীর সাথেও মিলানো যায়। কিংবদন্তীর এই জমিদার পুত্র মেট্রিক পাস করার পর লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন বরিশালের পত্রিকা সাপ্তাহিক হিতৈষী দিয়ে। আর সাংবাদিকতা শুরু সাপ্তাহিক নকিব পত্রিকা দিয়ে, ১৯৪৬ সালে। সাপ্তাহিক নকিবে এক সময় কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা লিখতেন। গাফফার চৌধুরী পিআইবি’র আয়োজনে ২০১৬ সালে স্মৃতিচারণে বলেছেন, “বরিশাল থেকে এখন অনেক দৈনিক কাগজ বের হয়। তখন দুটি কাগজ ছিল। দুটিই অত্যন্ত উন্নতমানের কাগজ।”
বোধগম্য কারনেই সেই বরিশাল আর এই বরিশাল মিলানো যাবে না। আর এই বরিশালেই লিটন বাশারকে দেখে সাংবাদিকতার অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়েছিলো আরিফিন তুয়ার। মৃত্যুর বছর দুই আগে দৈনিক কালবেলার বরিশাল ব্যুরো চীফ হিসেবে যোগদানের পর জীবনযাপনের দিশা পেয়েছিলো, কিছুটা হলেও। কিন্তু লিটন বাশারের মতো বড়ই অসময়ে চলেগেলো অভাগা আরিফিন তুষার! তার তুষারের জানাজায় শরিক হয়ে চ্যানেল ওয়ান-এর সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ইশতিয়াক ইমন ৯ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে লিখেছেন, “২৭ জুন ২০১৭ বরিশাল টাউন হল, লিটন বাশারের বিদায়। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বরিশাল টাউন হল, আরেফিন তুষারের বিদায়। বড় ভাই লিটন বাশারকে দেখে দু’জনই সাংবাদিকতায় এসেছিলাম। মেন্টর আগেই চলে গেছে যে পথে সে পথ ধরেই একজন বলে গেলো, এর পরের যাত্রার জন্য তৈরি থাকিস! অথচ আমি তো তৈরি আছি ৮ বছর ধরেই, ওপারে ভালো থাকিস ভাই।”
মানতেই হবে, দীর্ঘ পেশাগত জীবনে আমার যেমন একাধিক মেন্টর ছিলেন, তেমনই আমিও অনেকের মেন্টর ছিলাম, অবস্থান ও প্রবনতার কারণে। কিন্তু ইমনের মেনটর ছিলাম না। বরং সে আমার মেন্টর হবার উদারতা দেখিয়েছে টেলিভিশনে যোগদান করার পর। প্রসঙ্গ, নাইম ভাইর আমাদের সময়-এ ইমনকে সংযুক্ত করেছিলাম। বাকী পথ সে করেনিয়েছে। তার ক্ষেত্রে আমার অবদান কেবল এই ট্কুুই! এদিকে তুষারের যত না মেন্টর ছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলাম উস্কানীদাতা। এদিকে লিটন বাশার সাংবাদিকতা পেশায় আসার কারণ আমি। এবং মেন্টরও ছিলাম, অনেকটা গৃহশিক্ষকের মতো। প্রসঙ্গত, তার নয়া খালা আমার গৃহে তখন প্রবেশ করেছিলেন, সময়টা ১৯৯০ সাল। তখন তুষার হাফপ্যান্ট পরে, তবে বেশ পাকনা! একই বছর আমি এক্রিটিডিশন কার্ড পাই। অবশ্য এই প্রাপ্তি ছিলো আমার প্রথম চীফ রিপোর্টার বকুল ভাইর(খায়রুল আলম বকুল) কারণে। এই কার্ড দেখে কিশোর লিটনের এটি পাবার বাসনা সৃষ্টি হয়েছিলো। সে বলেছিলো, “খালু, আমার লাল কার্ড লাগবে।” জবাবে আমি তাকে লম্বা পথের দিশা দিয়েছিলাম। অনেকটা কুকুরের লেজ সোজা করার মতো। কিন্তু কার্ড হয়তো পায়নি, কিন্তু সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো লিটন। এদিকে আমার সেই এক্রিটিডিশন কার্ড গণবাতিল তালিকায় পড়েছে। এ বাতিল প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে, গণপিটুনি-গণধোলাই-গণসৌচাগার, গণধর্ষণসহ ইত্যাকার বাছাবাছা বাজে শব্দগুচ্ছ। যাক সে অন্য প্রসঙ্গ।
শওকত মাহমুদের মিডিয়া সিন্ডেকেট দিয়ে লিটন বাশার সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশ করে। অবশ্য, সাংবাদিকতা কোন পেশাই নয়! তখন মিডিয়া সিন্ডিকেটের বরিশাল ব্যুরো চীফ ছিলেন নজরুল ইসলাম রাজন। এটিও আমার ম্যানেজ করা। আর লিটন ছিলো অফিস ও মাঠের ‘কামলা’। অক্লান্ত পরিশ্রম, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে অসাধারণ সম্পৃক্ততা, স্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে কাজ করা, বরিশালের আজপর্যন্ত সেরা পত্রিকা দৈনিক আজকের বার্তার ভোলা ব্যুরা চীফ এবং পরে দৈনিক ইত্তেফাকের বরিশাল ব্যুরো চীফ হিসেবে দীর্ঘ সময় কঠিন দায়িত্ব পালন এবং বরিশাল প্রেস ক্লাবের নেতৃত্ব দিয়েছেন লিটন বাশার। এ ধারায় সে অনেকটা জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলো। তার এই সম্প্রসারণ ও বিকাশ আমার জন্য বিশেষ তৃপ্তির ছিলো। আমার আমৃত্যু থাকা স্বাভাবিক ছিলো এই তৃপ্তি। কিন্তু থাকেনি। কারণ লিটন চলেগেছে খুবই অসমে, ২০১৭ সালের ২৭ জুন। তার এই অকাল মৃত্যুতে এক ধরনের অপরাধ বোধে আক্রান্ত হয়েছি। মনে হয়েছে সাংবাদিকতায় না আসলে হয়তো এমনটা হতো না। এরপরও আরিফিন তুষারকে বলতাম, ‘ভাইকে অনুস্মরণ করো।’ কথার কথা হিসেবে এই বলার অপরাধবোধ থেকে অন্যরকম গভীর বেদনায় নিমজ্জিত হয়েছি গত ৮ সেপ্টেম্বর। ফেসবুক প্রভাবিত দেশের নাগরিক হয়েও বিশেষ কিছু লেখার অবস্থা ছিলো না। শুধু লিখেছি, ‘এই বিদায় অকল্পনীয়, অসহ্য……..।’ আর সাংবাদিকের জীবন নিয়ে বিষাদে নিমজ্জিত হয়েছি। এ ব্যাপারে সাংবাদিক মাসুদ কামালের একটি লেখার শিরোনাম মনে পড়ে, ‘এই জীবন সাংবাদিকের।’ এটি বই আকারে প্রকাশ করার কথা শুনেছি আরো এক যুগ, অথবা তারও আগে। প্রকাশিত হয়েছে কিনা জানি না। তবে না হওয়াই বেহেতের। কারণ, ছাত্ররাই তো বই পড়ার ধারা থেকে অনেক দূরে চলেগেছে। বই না পড়ার গণ-প্রবনতার যুক্ত হয়ে ছাত্রদের অনেকেই এখন দেশ-জাতি-রাষ্ট্র নিয়ে গলদঘর্ম। কেউকেউ আবার ‘অন্য কর্মে’ খুবই ব্যস্ত! সাংবাদিকের বই পড়বে কে!
অল্প সময় অনেক পথ পেরিয়ে মৃত্যুকালে লিটন বাশারের প্রধান পরিচয় ছিলো, সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যুরো চীফ এবং বরিশাল প্রেসক্লাব নেতা। এবং অকাল মৃত্যুকালে আরিফিন তুষারেরও প্রধান পরিচয়, সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিক কালবেলার বরিশাল ব্যুরো চীফ এবং প্রেসক্লাব নেতা। পেশা ও অন্তিম যাত্রায় কী অদ্ভূত অন্তমিল! এ প্রসঙ্গে বাংলাভিশনের বরিশাল প্রতিনিধি শাহীন হাসান তার ফেসবুক-এর লেখা উল্লেখ করা চলে। তিনি লিখেছেন, আমাদের আরেফিন তুষার, দৈনিক কালবেলার বরিশাল প্রতিনিধি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার খালাতো ভাই লিটন বাশার ভাইও এভাবে চলে গিয়েছিলেন। তাদের দুজনেরই দু’বছরের দুটি পুত্র সন্তান রয়েছে। লিটন ভাইর ছেলের আজ প্রায় ১২/১৩ বছর। বাচ্চা দুটির কথা মনে পড়লে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই! মৃত্যুর আগে তুষারের অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় সে অক্সিজেন সম্মিলিত একটি এম্বুলেন্স খবর দিতে বলেছিলেন। গোসল করেছেন! কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না! আরিফ রহমান লিখেছেন, সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ প্রিয় ছোট ভাই সাংবাদিক আরেফিন তুষার আমাদের মাঝে আর নেই। এভাবে হঠাৎ করে চলে যাওয়া খুবই বেদনাদায়ক। সাইদ মেমন লিখেছেন, সাংবাদিকতা জগতে সংবাদ আদান প্রদানের বাইরেও যে শক্ত বন্ধন তৈরি করা যায়, সেটা তুষার পারতো। অদৃশ্য কঠিন এক বন্ধন তৈরি করেছিলো। প্রিয় ছোট ভাই তুষার আজ সেই বন্ধনটি এ জগত থেকে ছিন্ন করে অন্য জগতে পারি দিয়েছে। খান রুবেল লিখেছেন, আমি অনেক বড় কিছু হারিয়েছি। যা বোঝাবার ভাষা নাই! রাসেল হোসেনের মন্তব্য, তুষার ভাই এত দ্রুত এভাবে চলে গেলেন। ভরসার অন্যতম একটা যায়গা হারিয়ে ফেললাম। কতশত স্মৃতি আপনার সাথে। সবসময় বলতেন, ‘লাগলে বলিস।’ দুদিন আগে শেষ দেখায় অতীত একটা স্মৃতি জাগিয়ে আড্ডা দিয়েছি। বলেছিলেন, ছেলে খুব মোটরসাইকেলে ঘুড়তে চায়। বাসায় থাকলে ছেলের কাছে মোটর সাইকেলের চাবি রাখতে হয়। কত আদরের অবুঝ ছেলেটা আজ এতিম হয়ে গেল। ছেলেটার দিকে আজকে যতবার তাকিয়েছি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। ছেলেটাকে আল্লাহ হেফাজত করুক, আমিন। আবরার হাসনাইন লিখেছেন, ভাই বলতে ছোটো থেকে চিনতাম তুষারকে। বয়সে আমার বড় ছিলো। কিন্তু ছিলো আমার বন্ধু। আজ আমি আবার একা হয়ে গেলাম। হারিয়ে ফেললাম বন্ধুর মতো বড় ভাইরে। আহারে আমার ভাই…!
আরিফিন তুষারের মৃত্যুতে অসংখ্য সাংবাদিক, অন্য জগতের মানুষ এবং আত্মীয়-স্বজন, এমনকি কুজনও হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণের কথা জানিয়েছেন। যেমনটা হয়েছে লিটন বাশারের বেলায়ও। এদিকে কেবল অকাল মৃত্যু এবং অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা নয়, লিটন বাশার ও আরিফিন তুষারের মধ্যে অনেক মিল আছে। যদিও সঙ্গত কারণেই মাত্রায় পার্থক্য অনেক। তবে সাংবাদিকতায় একাগ্রতা এবং মানুষের পাশে থাকার প্রবনতার ক্ষেত্রে এরা ছিলো অভিন্ন। তারা অনন্য এক দৃষ্টান্ত ছিলেন। একই ধরনের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন বরিশাল প্রেসক্লাবের সেক্রেটারী এস এম জাকির। কোন সহকর্মীর পাশে থাকা, কারো মৃত্যু হলে একজন সাংবাদিক নেতা যে কতটা ভূমিকা রাখতে পারেন সে দৃষ্টান্ত সে বহুবার স্থাপন করেছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছি লিটন বাশার ও আরিফিন তুষারের বেলায়। সাংবাদিক নেতা হিসেবে তিনি বরিশালে এক মডেল হয়ে উঠেছেন বলে অনেকেই বলছেন। এদিকে শুধু এস এম জাকির নন, বরিশালের সাংবাদিকদের মধ্যে সহকর্মীর পাশে দাঁড়ানোর প্রবনতা খুবই প্রবল। বরিশাল প্রেসক্লাবের সভাপতি আমিনুল ইসলাম খসরু, বাংলাদেশ বাণীর প্রকাশক এডভোকেড শাহে আলমসহ অনেক সাংবাদিক নৌ ও সড়ক পথ পেরিয়ে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে গ্রামের বাড়িতে তুষারের দাফনে অংশ নিয়েছেন। এর আগে বরিশাল টউন হল চত্বরে প্রথম জানাজার আয়োজন করেছেন সাংবাদিকরাই। এর আগে আরিফিন তুষারকে অফিস থেকে হাসপাতালে নেয়া, মরোদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌছানো, জানাজা-দাফন-মিলাদ, সবকিছুতেই প্রধান ছিলেন সাংবাদিকরা। এরা যেনো এক ঘরের স্বজন, সহোদরের মতো। এটি কেবল আমি নই, অসংখ্য মানুষ জানেন। কিন্তু বরিশালের অনেকেই এখনো যা জানেন না তা হচ্ছে, দৈনিক কালবেলার ভূমিকা। একাধিক সাংবাদিক-কর্মী তুষারের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন। কেঁদেছেনও কেউকেউ। প্রতিমূহুর্তে খবর রেখেছেন সম্পাদক সন্তোষ শর্মা স্বয়ং। আর তরিকুলের বিষয় তো অন্য রকম। যেনো, তুষার তার আপন ভাই ছিলো। তার আকুল কান্নার কথা সম্ভবত রুবেল আমাকে জানিয়েছে। এদিকে কালবেলা সম্পাদক কেবল খোঁজ খবর নিয়ে ইতিটেনেছেন- এমন নয়। তিনি তুষারের স্ত্রী-পুত্রের জন্য অবদান রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে জেনেছি। আমার জানামতে, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু একই রকম ভূমিকা রেখেছিলেন লিটন বাশারের বেলায়ও। এই ধারা আর কয়টা পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠানে আছে তা বলা কঠিন। তবে থাকলেও তেমন দৃশ্যমান নয়। ভবিষ্যতে হয়তো এই ধারা অধিকতর দৃশ্যমান হবে। যে ধারা চলছে জাপানে। যেখানে কর্মীরা বিবেচিত হয় ঘরের সদস্য হিসেবে, কবরেরও খবর রাখে প্রতিষ্ঠান!
লেখক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
শব্দ: ১২৭৯