একবিংশ শতাব্দিতে এসে যখন শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা, কর্মস্থলের বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমবর্ধমান। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও বেশি এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা,অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে ঠিক তখনও প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলোতে এর বিপরীত অবস্থা বিদ্যমান।
নারীদের শিক্ষার ব্যাপারেই খুবই উদাসীন এখানের সমাজব্যবস্থা। গ্রামাঞ্চলে এখনো সেই আদি যুগের মতই নারীদেরকে সমাজ এবং পরিবারের বোঝা মনে করা হয়। আর তাইতো কোনরকমে বুঝে উঠার আগেই মেয়েদেরকে বিয়ে দিয়ে বোঝা সরিয়ে দায়মুক্ত হলেই যেন নিস্তার পরিবার গুলোর।তাদের চিন্তাভাবনা গুলো এমন যে,মেয়ে মানেই সংসার করবে,সন্তান লালন-পালন করবে,মেয়েদেরকে পড়াশুনা করিয়ে কোন লাভ নাই। এরই ধারাবাহিকতায় কোনরকমে মাধ্যমিকটাও শেষ করতে পারেনা মেয়েগুলো আগেই শুরু হয় তাদের বিয়ে দেওয়ার পায়তারা, ছেলে পক্ষকে দেখানো এবং যেমন-তেমন একটা টাকাওয়ালা ছেলের কাছে বিয়ে দিতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে পরিবারগুলো।
আইনানুগ ভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ জানা স্বত্বেও ১৮ বছর পূর্ন হওয়ার আগেই পরিবারগুলো বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিচ্ছে মেয়েগুলোকে। আইনানুগ ভাবে যে সবাই পেয়ে পাড় যাচ্ছে ব্যাপারটা কিন্তু এমন ও না। ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের আয়োজন করায় পুলিশ অভিবাবকদের জরিমানা করতেছে,বিয়ের অনুষ্ঠান ভেঙে দিচ্ছে এমনকি হাজতে পর্যন্ত নিচ্ছে বিয়ের সাথে জড়িত লোকজনদের তাও বাল্যবিবাহ কমার বিন্দু মাত্র প্রবণতা নেই এখানে। বরং আইনের ভয়ে রাতের আধারে আইনানুগ নিবন্ধন ছাড়াই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করছে নারীদেরকে।ফলশ্রুতিতে কি হচ্ছে ?
বৈবাহিক জীবনে যেকোন ঝামেলা এমনকি যৌতুকের জন্যও যদি নারীদের উপর অত্যাচার চালায় শশুর বাড়ির লোকজন আইনের শরণাপন্ন পর্যন্ত হতে পারেনা নারীরা।এছাড়া বাল্যবিবাহের ফলে অপ্রাপ্ত বয়সে বাচ্চা জন্মদানের ফলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভোগে নারীরা যেটার প্রভাব তার সদ্য জন্মানো শিশুর উপরও পড়ছে।
এখানের সমাজব্যবস্থাটা এখনও এমনই রয়ে গেছে যে, মেয়েদের পড়াশুনা করিয়ে বিয়ে দিতে গেলে বয়স বেশি হয়ে যাবে তখন আর ভাল ছেলে পাওয়া যাবেনা। আর মেয়েদের পড়াশুনা করানো মানে টাকা নষ্ট করা, তার চেয়ে বরং মোটা অংকের টাকা যৌতুক দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতেও তারা নারাজ নন।তাদের এই মূর্খ চিন্তা ভাবনার কাছে প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে অনেক গুলো স্বপ্ন,অনেক গুলো সুপ্ত প্রতিভা যেটা একটু খানি আশার আলো পেলেই হয়ত জ্বলে উঠতে পারত, লিপিবদ্ধ করতে পারত নিজের নামটাও বিশ্বের সকল সফল লোকদের ভীড়ে।
যেখান নবম-দশম শ্রেনীই শেষ করতে পারেনা মেয়েরা, সেখানে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছান তো দূরে থাক এটা ভাবা বা স্বপ্নে দেখার মত সুযোগও হয়না অধিকাংশ মেয়েদের।হাতে দুই-একজন হয়ত নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত পৌছায়, তবে সেই সংখ্যাটা খুবই কম। আসলে আমরা এই অন্ধকারাচ্ছন্ন চিন্তা থেকে কবে বের হয়ে আসতে পারব??আদৌ পারব কি??
উত্তর টা জানা নেই। একটা সন্তানের সুশিক্ষিত ভাবে বড় হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা তার পরিবারের, বিশেষ করে তার মায়ের। তো মা নিজেই যদি উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ না পায় তবে সে তার সন্তানকে কি শিখাবে?
আর সন্তানদের উপযুক্ত পারিবারিক শিক্ষা না দিতে পারার প্রভাবও কিন্তু আমাদের সমাজে বিদ্যমান।সমাজে বিভিন্ন অপরাধ অহরহ বেড়েই চলছে যার মূল হোতা হচ্ছে উপযুক্ত পারিবারিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত তরুণ সমাজ। একটা নারী শিক্ষা অর্জন করলেই তাকে চাকরী করতে হবে এমনটাতো না।নারী চাকরী না করুক, অন্তত একটা শিশুকে সুশিক্ষিত এবং বর্তমান সময়ের জন্য উপযুক্ত ভাবে মানুষ করার জন্য হলেও নারী পড়াশুনা করুক।১৮ বছর পার করার সাথে সাথেই নারীকে বিয়ে দিয়ে দিক সমস্যা নাই, সে সংসার করুক, সন্তান লালন-পালন করুক, কিন্তু তাকে যেন উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না করা হয়।নারীকে যেন উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ দেওয়া হয় আর সেই বিষয়টা নিশ্চিত করার জন্য সমাজ নির্ধারক থেকে শুরু করে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুন সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে,সমাজের স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের কাছে নারী শিক্ষার গুরুত্বকে তুলে ধরতে হবে সাথে নারীদেরকেও শিক্ষা অর্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে।মনে রাখতে হবে একটা সমাজ তথা দেশের অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আর একটা শিশুর সুশিক্ষিত ভাবে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে সর্বোপরি একটা সুশিক্ষিত জাতি গড়ার ক্ষেত্রে একজন সুশিক্ষিত মায়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
লেখকঃ
ফাতেমা তুজ জহুরা
শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ,
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ।