ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে রেজাউল করিম মল্লিককে। তাকে ডিএমপি সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। শনিবার (১২ এপ্রিল) ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এর কারণ কী? তিনি কি সাবেক নটরিয়াজ ডিবি প্রধান হারুনের পথে হাটতে শুরু করেছিলেন!
আদেশে বলা হয়, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিককে ডিএমপির সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক স্বার্থে রেজাউল করিম মল্লিককে তার নামের পাশে উল্লেখিত স্থানে পদায়ন করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক। সাধারণত ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করা হলে সঙ্গে সঙ্গে পদায়ন করা হয়। কিন্তু রেজাউল করিম মল্লিককে ডিএমপি সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। সংযুক্ত হওয়া হচ্ছে, আপাতত ওই কর্মকর্তার কোনো পদ নেই। গতকাল পর্যন্ত তাকে কোথাও পদায়ন করা হয়নি। পাশাপাশি ডিবিপ্রধানের পদেও কাউকে পদায়ন দেওয়া হয়নি।
রেজাউল করিম মল্লিক ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। তিনি ১৭তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা। এর আগে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২২ সালের জুলাই মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগের প্রধান হিসেবে মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে গত ৩১ জুলাই এক আদেশে হারুনকে সরিয়ে ডিএমপির লজিস্টিক, ফিন্যান্সের অতিরিক্ত কমিশনার আশরাফুজ্জামানকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তার স্থলাভিষিক্ত হন রেজাউল করিম মল্লিক।
ধারণা করা হয়, বিতর্কিত প্রক্রিয়ায় মডেল মেঘনা আলমকে আটকের পর দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের ডিবিপ্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত কমিশনার। এর আগে গত ৯ এপ্রিল রাতে মডেল মেঘনা আলমকে রাজধানীর ভাটারা এলাকার বাসা থেকে আটক করে হেফাজতে নেয় ডিবি। মেঘনা তার ফেসবুকে বিষয়টি লাইভ করলে সেটি ভাইরাল হয় এবং বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলে তুমুল আলোচনার ঝড় ওঠে।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, মামলা বা সুনির্দিষ্ট কারণ না জানিয়ে মেঘনা আলমকে বাসার দরজা ভেঙে ফিল্মি স্টাইলে আটকের ঘটনায় দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিতর্কিত প্রিভেনটিভ ডিটেনশন বা প্রতিরোধমূলক ধারায় তাকে কেন আটক করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আন্তর্জাতিক মহলেও। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। শুরুতে ডিবির পক্ষ থেকে মেঘনাকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে সিএমএম আদালতের মাধ্যমে ওই তরুণীকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিতর্কিত ধারায় তাকে ৩০ দিনের আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়া হয়।
এদিকে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মেঘনা আলমকে আটকের পর গত তার সহযোগী হিসেবে দেওয়ান সামির নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে ভাটারা থানা পুলিশ চাঁদাবাজির মামলা দেয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন বিশেষ সহকারী দেওয়ান সামিরের কদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে, তা ডিবিপ্রধানের কাছে ফোন করে জানতে চান। ওই সময়ে ডিবিপ্রধান বিশেষ সহকারীকে জানান যে, পুলিশ মামলা দিয়ে আসামিকে আদালতে পাঠিয়েছে। রোববার রিমান্ড শুনানি হবে। এটা শুনে ক্ষিপ্ত হন বিশেষ সহকারী। এ নিয়ে শনিবার রাতেই আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারকে অবহিত করেন বিশেষ সহকারী। তারা দুজনই বিষয়টি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। তবে বিশেষ সহকারী ডিবিপ্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। এরপরই ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী বদলি আদেশ জারি করেন। ওই আদেশে ডিবিপ্রধানকে ডিএমপির সদর দপ্তরে সংযুক্ত করে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক স্বার্থে তাকে তার নামের পাশে উল্লেখিত স্থানে (ডিএমপি সদরদপ্তরে সংযুক্ত) পদায়ন করা হলো।
যা ঘটেছে
আটকের সময়
মেঘনা আলমকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয় গত ৯ এপ্রিল থেকে। ওইদিন রাতে তাকে তার ঢাকার বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মেঘনা আলম ২০২০ সালের পাঁচই অক্টোবর মিস আর্থ বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। পাশাপাশি, তিনি ‘মিস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানও।
রাতে পুলিশ মেঘনা আলমকে যখন আটক করতে যায়, সে সময় তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে লাইভ করেন। সেই লাইভে তিনি বলছিলেন, তার দরজার বাইরে পুলিশ পরিচয়ধারীরা তাকে নিতে এসেছে। মেঘনা আলমের ফেসবুক লাইভ চলার সময়ই তার বাসায় পুলিশ প্রবেশ করে এবং তখন লাইভ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১২ মিনিট ধরে চলা ফেসবুক লাইভ পরে তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকেও সরে যায়। কিন্তু ১২ মিনিটের ওই ফেসবুক লাইভ ততক্ষণে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকেই সেটি ডাউনলোড করে পুনরায় পোস্ট করে। আটক হওয়ার আগমুহুর্তে সেই লাইভে তিনি শুরুতেই বলছিলেন, তার বাসায় “কিছু মানুষ আক্রমণ করেছে। তারা নিজেদেরকে পুলিশ পরিচয় দিচ্ছে। আমি বলেছি থানায় এসে কথা বলবো, তারা কথা শুনছে না।” লাইভের ভিডিও-তে মেঘনা আলমকে দরজার বাইরে থাকা লোকেদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, “আপনারা আমার দরজার ভাঙ্গার চেষ্টা করছেন। আমার ভয় পাওয়া তো স্বাভাবিক…. না?” ওই ভিডিও-তে কথোপকথনে শোনা যায়, মেঘনা আলমকে আটক করতে সাত-আট জন ‘পুলিশ পরিচয়ধারী’ এসেছে এবং তাদের হাতে বন্দুক ছিল।
মেঘলা আলম ঐ ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা যার কথায় এখানে এসেছেন… তাকে কখনও আমি আমার বাসায় ঢুকতে দেইনি। আপনার তো আমাকে ফোন করে আসার কথা।” এই নারীর দাবি, বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের কথায় ‘পুলিশ’ তার বাসায় এসেছে এবং একপর্যায়ে ভিডিওতে তিনি বলেন, তাকে মাদকমামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। দরজার ওপাশ থেকে তাকে দরজা খুলতে বলা হলে মেঘনা আলম বলেন, আইন অনুযায়ী তাকে “কারণ (দরজা খোলার) বলতে হবে। অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট থাকতে হবে।”