• ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিক পীড়নে শেখ হাসিনার কোনো লাভ হয়েছে?

দখিনের সময়
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৬, ২০২৫, ১৮:৪৪ অপরাহ্ণ
সাংবাদিক পীড়নে শেখ হাসিনার কোনো লাভ হয়েছে?
সংবাদটি শেয়ার করুন...
আমাদের প্রতিটি সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলে। প্রচলিত প্রবচন, সরকারি কর্তাদের বচন অমৃতসম। আসলে এটি হচ্ছে একধরনের রসিকতা। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি লোকদের বচন সাধারণত খুব একটা আমলে নেওয়া হয় না। বরং প্রায় ক্ষেত্রেই উল্টোটা ভাবে আমজনতা। আর যুগে যুগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত বখেদমতে হুজুরে আলাদের বচন আরও কম গুরুত্ব পায়। বরং ধরেই নেওয়া হয়, তথ্যমন্ত্রী মানেই সরকারের অতিকথনের মাইক। এ ক্ষেত্রে নিজ মহিমায় ড. হাছান মাহমুদ এক নম্বর পদটি সর্বকালের জন্য দখলে রাখার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। আর জনগণের বিবেচনায় তথ্যমন্ত্রী হিসেবে ড. হাছান মাহমুদের পর দ্বিতীয় আসনটি চিরকালের জন্যই তোলা রয়েছে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার জন্য। এদিকে অতিকথনের ধারায় সম্পৃক্ত হননি, অথবা পূর্বসূরিদের ধারায় অভ্যস্ত হওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পাননি নাহিদ ইসলাম। কিন্তু ইতিহাসে লেখার মতো একটি কাজ করে গেছেন তিনি! গণপিটুনির মতো কলমের এক খোঁচায় সব সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করে গেছেন। বলা হয়, এভাবে ড. ইউনূস সরকারের প্রতি সাংবাদিকদের বৈরী করার ক্ষেত্রে অসাধারণ ‘সাফল্য’ দেখিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। ফলে তাঁকে অবশ্যই আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রচলিত এই ধারার মধ্যেও তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গত ৮ অক্টোবর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি হলো কোনো গণমাধ্যম বন্ধ করা হবে না। যেহেতু কোনো গণমাধ্যম বন্ধ হচ্ছে না, তাই নতুন গণমাধ্যমের অনুমতি দেওয়া হবে। তবে এটি আগের নিয়ম অনুযায়ী করা হবে। সরকার মিডিয়া শিল্পে একটি ভালো পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে। আমরা চেষ্টা করছি একটা ভালো পরিবেশ তৈরি হোক। সেলফ রেগুলেশনে আসুক। মন্ত্রণালয় এখানে হস্তক্ষেপ করবে না।’
তথ্য উপদেষ্টার এ উচ্চারণ অনেক গভীরের বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। বেশ বিলম্ব হলেও মাহফুজ আলম (১০ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ) আসলে অনেক বড় রকমের অরাজকতা বিদায়, নিদেনপক্ষে চেষ্টা করার প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর মন্ত্রণালয়ের কতিপয় আমলা এবং সারা দেশে কতিপয় ডিসি ও দালালের ধান্দার গরম ভাতে জল ঢেলে দিয়েছেন। একই সঙ্গে গণমাধ্যমকেন্দ্রিক ফাঁপরবাজ-চাঁদাবাজ এবং মবোক্রেসির লাগাম নীরবে টেনে দিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা। শুধু তা-ই নয়, সরকারকে বড় ধরনের একটি কলঙ্কের নিশ্চিত গ্রাস থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। হয়তো এ ক্ষেত্রে বেশ বিলম্ব হয়েছে। তবু কখনো না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে হওয়া উত্তম। এরপর প্রশ্ন থাকেই, জেলায় সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ডিসিরা কী করছেন? উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ৮ অক্টোবরের পরিষ্কার বক্তব্যের ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় ১৩ অক্টোবর উল্টো ধারার তাগত দেখিয়েছেন ময়মনসিংহের ডিসি। তিনি কলমের এক খোঁচায় ১১ পত্রিকার ডিক্লেয়ারেশন বাতিল করে দিয়েছেন। ময়মনসিংহের ডিসি কোনো উগ্র এজেন্ডার ধারক কি না, কে জানে। অথবা তাঁরা মগজ আওয়ামী চেতনায় পরিপূর্ণ!
অনেকের স্মৃতিতেই আছে, স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ওপর খড়গ চালিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সংবাদপত্রের ওপর তিনি খড়গহস্ত হয়েছিলেন। অথচ গণতন্ত্রের জিকির এবং মানুষকে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখিয়েই তিনি বটবৃক্ষসম নেতা হয়েছিলেন। এদিকে সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল দীর্ঘকালের। এমনকি প্রথম জীবনে তিনি সংবাদপত্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িতও ছিলেন। ইত্তেহাদ পত্রিকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। সংবাদপত্র, সাংবাদিক এবং গোটা সংবাদজগতের ঘরেবাইরের অনেকটাই তিনি জানতেন। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক মঞ্চে তিনি যখন প্রায় একাকী পাক চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন তখন সংবাদপত্র জগতের কর্মীরাই ছিলেন তাঁর বড় সহায়ক। ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও শেখ মুজিব ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। হরিহর আত্মা। মুজিব যেমন ইত্তেফাকের জন্য লড়াই করেছেন, চাঁদা তুলেছেন; তেমনই বিপদের দিনে ইত্তেফাকও তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে বটবৃক্ষ হয়ে। ফলে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর একটি আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এ আবেগের কথা তিনি ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছেনও। তাঁর উচ্চারণ, ‘সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনারা জানেন, আমি আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আপনাদের অনেক সহকর্মী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তাঁরা আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন।’ কিন্তু ইতিহাসে লেখা আছে, চারটি ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ করেছিলেন সাংবাদিকদের ‘বন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য এই কর্ম তিনি করেছিলেন একটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে। যে কমিটির শিরোমণি ছিলেন এনায়েত উল্লাহ খান। এটি সবাই না জানলেও অনেকেই জানেন। আর ১৫ আগস্টের পর সবাই জেনেছে, এনায়েত উল্লাহ খান ছিলেন ’৭৫-এর থিংক ট্যাংকের অন্যতম কুশীলব। এদিকে গণমাধ্যম পীড়নে কেবল মুজিব নয়, মুজিবকন্যাও পিছিয়ে ছিলেন না। একটি প্রবচন আছে, ‘বাপ কা বেটা’। অনেকের বিবেচনায়, শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তিনি, বাপ কা বেটি! মুজিবকন্যা দ্বিতীয় দফায় ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার দীর্ঘ ১৬ বছরে বহু কাণ্ডের সঙ্গে গণমাধ্যমের ওপরও আঘাত হেনেছেন। খালেদা জিয়া সরকারের তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভাজনের মাধ্যমে গণমাধ্যমবিরোধী যে সর্বনাশা খেলার সূচনা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা করেছেন তাকে সাপলুডুর মই ধরিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। শুধু তা-ই নয়, হাড্ডি ছুড়ে দিয়ে রাজনীতিকদের লেজ কাটার এরশাদীয় তরিকা গণমাধ্যমে কপি পেস্ট করে একটি অনুগত সাংবাদিক শ্রেণি তৈরি করেছিলেন শেখ হাসিনা। আর যাঁরা অনুগত হতে চাননি অথবা যথেষ্ট আনুগত্য দেখাতে পারেননি তাঁদের জন্য ছিল অন্য ব্যবস্থা। মানে হামলা-মামলা ইত্যাদি! আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলেও এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যার প্রায় ২৩ শতাংশ নির্যাতনই হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ১১৯ জন সাংবাদিক নানামুখী হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৮ জন পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলা এবং ১৯ জন প্রকাশিত সংবাদের জেরে মামলার শিকার হন। পলাতক হাসিনা সরকারের আমলে সাংবাদিক নির্যাতনের আখ্যান অনেক দীর্ঘ। সাংবাদিক পীড়নে শেখ হাসিনার কি কোনো লাভ হয়েছে? হয়নি! কখনো হয় না। চলমান শাসনের অবস্থা কী? গত ১৬ মাসে বাংলাদেশে ছয়জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৪৭৬টি ঘটনায় ১ হাজার ৭৩ জন গণমাধ্যমকর্মী বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা কী অবস্থা মোকাবিলা করছেন তার যথার্থ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রসঙ্গত পত্রিকা বন্ধের কাণ্ড শেখ মুজিব করেছিলেন এনায়েত উল্লাহ খানের নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে। ১৫ আগস্টের পর জানা গেল, এনায়েত উল্লাহ খান ছিলেন ’৭৫-এর থিংক ট্যাংকের অন্যতম সক্রিয় সদস্য। এ প্রসঙ্গে নির্মল ধারার সাংবাদিক চিরকুমার সজ্জন নির্মল সেন লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে অক্ষম, এনায়েত উল্লাহ খান কী করে বাকশালের সমর্থনে বিদেশে সাংবাদিক প্রতিনিধিদল নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর তাঁর ভূমিকা আমাকে বিস্মিত করেছিল।’ আবু জাফর শামসুদ্দীনের ভাষ্যমতে, ‘এনায়েত উল্লাহ খানরাই বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব বন্ধ করার অকাজটি করিয়ে নিয়েছিলেন।’ চারটি পত্রিকা রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেওয়ার মুজিবীয় কাণ্ড নিয়ে অবশ্য দুই ধরনের বয়ান প্রচলিত আছে। এক. তাঁকে দিয়ে এনায়েত উল্লাহ গং করিয়েছেন। দুই. শেখ মুজিব অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রাখার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা যা-ই হোক, পত্রিকা বন্ধের কলঙ্ক তিলক কিন্তু শেখ মুজিবের কপালেই অমোছনীয় হয়ে গেছে এবং তিনি গণমাধ্যম নিপীড়ক হিসেবেই ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন। আর বলাবাহুল্য সাম্প্রতিক সময়ে জেলায় জেলায় পত্রিকার ওপর সরকারের একশ্রেণির কর্মকর্তা যে কাণ্ড ঘটাচ্ছেন তার চূড়ান্ত দায় কিন্তু ইতিহাসে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপরই বর্তাবে। যেমন চেপে বসেছে শেখ মুজিবের ঘাড়ে।
# বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫। শিরোনাম, ‘কঠিন সময়ে গণমাধ্যম’