Home ফিচার জাগরণের কবি গোলাম মোস্তফার মৃত্যুদিবস আজ

জাগরণের কবি গোলাম মোস্তফার মৃত্যুদিবস আজ

“অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি

বিচার দিনের স্বামী।

যত গুণগান হে চির মহান

তোমারি অন্তর্যামী।”

আলম রায়হান:

কবি গোলাম মোস্তফার অমর কবিতার কয়েকটি চরন। শ্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পনের বিনয়ী এবং নান্দনিক প্রকাশ গোলাম মোস্তফার  এ কবিতাটি। রেঁনেসার কবি গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অনন্য অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন এক ধ্রুবতারা।

জাগরণের কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত কবি গোলাম মোস্তফা ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক বাংলা ১৩০২ সনের ৭ পৌষ, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী গোলাম রব্বানী এবং পিতামহ কাজী গোলাম সরওয়ার। তাঁরা ছিলেন সাহিত্যানুরাগী এবং ফারসী ও আরবী ভাষায়  সুপন্ডিত। কবি গোলাম মোস্তফার তিন পুত্রের মধ্যে একজন হচ্ছেন, বিখ্যাত পাপেট নির্মাতা ও চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার। অস্কারজয়ী বাংলাদেশী নাফিস বিন জাফর তার নাতি।

গোলাম মোস্তফার শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় চার বছর বয়সে নিজগৃহে। এরপর তাকে পাঠানো হয়, পার্শ্ববর্তী দামুকদিয়া গ্রামের পাঠশালায়। কিছুদিন পরে তিনি ফাজিলপুর গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন। দু’বছর এ পাঠশালায় লেখাপড়ার পর তাকে শৈলকূপা উচ্চ ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করা হয়। ১৯১৪ সালে এই স্কুল থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা তথা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন কবি গোলাম মোস্তফা। ১৯১৬ সালে তিনি দৌলতপুর বি. এল কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯১৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। পরে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি ডিগ্রী লাভ করেন কবি গোলাম মোস্তফা।

কবি গোলাম মোস্তফার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে স্কুল জীবন থেকেই। মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় তার ‘আর্দ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘রক্ত রাগ’ প্রকাশিত হলে তিনি বেশ আলোচিত হন। এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি গোলাম মোস্তফাকে অভিন্দন জানিয়ে লিখেছিলেন:

“তব নব প্রভাতের রক্তরাগখানি মধ্যাহ্নে

জাগায় যেন জ্যোতির্ময়ী বাণী।”

অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী’তে ‘আন্দ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ শিরোনামের কবিতা প্রকাশের পর কবি গোলাম মোস্তফা বেশ আত্মপ্রত্যই হয়েওঠেন। এর পর দীর্ঘ ৫০ বছর নানান ধরনের রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে রক্তরাগ, হা¯œাহেনা, খোশরোজ, সাহারা, বুলবুলিস্তান, কাব্যকাহিনী ও বনি আদম  নামের সাতটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ, মুসাদ্দাস-ই-হালী, শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া, ইখওয়ানুস সাফাসহ চারটি অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ, রূপের নেশা ও ভাঙ্গা বুক নামের দু’টি উপন্যাস বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। কবি গোলাম মোস্তফার গীতি সঞ্চায়ন নামের দু’টি গানের সংকলন; ইসলাম ও কমিউনিজম, ইসলাম ও জেহাদসহ চারটি রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ; বিশ্বনবী, মরুদুলাল ও হযরত আবুবকর নামের তিনটি জীবনী গ্রন্থ, আল-কুরআন নামে কুরআনের একটি অনুবাদ গ্রন্থ; আমার চিন্তাধারা ও গোলাম মোস্তফাঃ প্রবন্ধ সংকলন নামের দু’টি প্রবন্ধ সংকলন বিশেষভাবে সমাদ্রিত হয়েছে সাহিত্য অঙ্গনে। আলোকমালা (সিরিজ), আলোকমঞ্জুরী (সিরিজ), মঞ্জুলেখা, মণিমুকুর, খোকা-খুকীর বই, বাংলা ব্যাকরণ  নামে বেশ কয়েকটি শিশু পাঠ্যপুস্তক রয়েছে কবি গোলাম মোস্তফার।

অনুবাদক হিসেবেও কবি গোলাম মোস্তফা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আরবী ও উর্দু সাহিত্য থেকে ইখওয়ানুস সাফা, মুসাদ্দাস-ই-হালী, কালাম-ই-ইকবাল, শিকওয়া অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। এছাড়া ‘আল-কুরআন’-এরও বাংলা অনুবাদ করেছেন। চিন্তামূলক ও যুক্তিবাদের উপর লেখা ইসলাম ও কমিউনিজম, ইসলামে জেহাদ, আমার চিন্তাধারা-  গ্রন্থগুলি কবি গোলাম মোস্তফার কালোতীর্ন ফসল।

কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ একটি আশ্চর্য রকমের সফল সৃষ্টি। এই অমর গ্রন্থটি গদ্যে রচিত হলেও তা ছিলো কবিতার মত ছন্দময়। এ  বইটি বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর একটি সার্থক জীবন চরিত। হৃদয়ের আবেগ, আন্তরিক অনুভূতি যে ভাবে বর্ণিত হয়েছে তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল।

সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন পেশায় শিক্ষক। ১৯২০ সালে জানুয়ারী মাসে ব্যারাকপুর সরকারি হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে তার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়। ১৯২৪ সালে ব্যারাকপুর হাই স্কুল থেকে তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুলে বদলী হন। দীর্ঘদিন এখানে শিক্ষকতা করার পর তিনি বদলী হন কলকাতা মাদ্রাসায়। সেখান থেকে ১৯৩৫ সালে বালিগঞ্জ সরকারি ডিমনেষ্ট্রেশন হাই স্কুলে বদলী হন। এ স্কুলে থাকা কালেই তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে পদোন্নতি পান। কয়েক বছর পর এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব লাভ করেন কবি গোলাম মোস্তফা। এই বিদ্যালয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক। ১৯৪০ সালে বাঁকুড়া জিলা স্কুলে বদলী হন কবি গোলাম মোস্তফা। ১৯৪৬ সালে তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৫০ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন কবি গোলাম মোস্তফা।

সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও কবি গোলাম মোস্তফা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। গায়ক ও গীতিকার হিসেবেও তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিলো। বিশেষ করে ইসলামী গান, গজল ও মিলাদ মাহফিলের বিখ্যাত ‘কিয়ামবাণী’ রচনায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।

সাহিত্যের আঙ্গিক-প্রকরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের অনুসারী হলেও কবি গোলাম মোস্তফার সাহিত্যকর্মের মূল উপজীব্য ছিলো ইসলামি আদর্শ ও ঐতিহ্য। এ  সম্পর্কে কবি লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও আমার মনে জেগেছিল আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দুর্জয় আকাংখা। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তাগিদে নয়, সহজভাবে আমি বাংলা সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামী কৃষ্টির রূপায়ণ।”

কবিতার মাধ্যমে সুপথে থাকার প্রার্থনার কবি, গোলাম মোস্তফা পরপারে চলে গেছেন ১৯৬৪ সালের আজকের দিনে।

“যে-পথে তোমার চির-অভিশাপ

যে-পথে ভ্রান্তি, চির-পরিতাপ

হে মহাচালক, মোদের কখনও

করো না সে পথগামী।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

স্কলারশিপ-এ পাকিস্তানে পড়ার সুযোগ ১০০ বাংলাদেশি, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন

দখিনের সময় ডেস্ক: বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের অনুমোদন দিয়েছে পাকিস্তান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ স্কলারশিপে ১০০ বাংলাদেশিকে পাকিস্তানে পড়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টির অনুমোদন দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম...

জনসমর্থন ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে বিএনপি

দখিনের সময় ডেস্ক: বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এক-এগারোর সরকারের মতো দুই নেত্রীকে মাইনাস করার কোনো কৌশল এ সরকারের...

নতুন সিইসি সাবেক সচিব নাসির উদ্দীন, নিয়োগ পেলেন চার কমিশনারও

দখিনের সময় ডেস্ক: সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে...

আমাদের দায়িত্ব সবাইকে একটি পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা: প্রধান উপদেষ্টা

দখিনের সময় ডেস্ক: অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। এই নতুন দেশে আমাদের...

Recent Comments