আতাউর রহমান খান মেধাবী মানুষ, সুবিধাবাদী নেতা
প্রকাশিত অক্টোবর ৭, ২০২৫, ২০:৩৮ অপরাহ্ণ

১৯৮৩ সালে আতাউর রহমান খানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন আলম রায়হান

আলম রায়হান:
বাংলাদেশ জাতীয় লীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত আতাউর রহমান খান অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ছিলেন খুবই আপোষকামী। বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আতাউর রহমান খান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। এ জন্য তাকে জেলও খাটতে হয়েছে। পরে শেখ মুজিবের বাবশালে যোগ দিয়েছেন। এমন কী এরশাদ সরকারের গৃহপালিত প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। তবে নয় মাসেই তাঁকে পত্রপাঠ বিদায় করেছেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ।
আতাউর পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাকশালে যোগ দিয়ে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর বাকশাল বিলুপ্তি হলে তিনি জাতীয় লীগ পুনরায় সংগঠিত করেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-২১ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে জয়ী হন। একই নির্বাচনে মফিজুল ইসলাম কুমিল্লা থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন। আতাউর রহমান খান ১৯৮৩-৮৪ সালে সাত দলীয় জোটের অন্যতম নেতা হিসেবে এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরিক ছিলেন। পরে জাতীয় লীগ বিলুপ্ত করে তিনি ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ১৯৮৫ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত। এর পর আমেনা বেগম জাতীয় লীগকে ‘জিন্দা’ করে রাজনীতির মাঠে নামেন। তখন তিনি কর্নেল ফারুক-রশিদের তল্পিবাহক ছিলেন। আর পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে আমেনা বেগম আওয়ামী লীগের তুখোড় নেত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা কারারুদ্ধ হয়ে পড়ায় তিনি আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছিলেন। সে সময় তিনি পুরো পূর্ব পাকিস্তান চষে বেড়িয়েছেন। সেই সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের একমাত্র কান্ডারী।
আতাউর রহমান খান ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠনের সময় সহ-সভাপতির (১৯৪৯-৬৪) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছরে পূর্ববঙ্গ সরকারের বেসামরিক সরবরাহ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ভেঙে দেওয়া হলে আতাউর ১৯৫৫ সালে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ভোটে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সদস্য থাকাকালীন তিনি বিরোধী দলের নেতা এবং উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নিয়ে সামরিক শাসন জারির (১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর) পূর্ব পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে আতাউরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের কারণে তিনি সমালোচিত হন। তার ছেলে জিয়াউর রহমান খান বিএনপির মনোনয়নে থেকে বেশ কয়েকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠিত হয়। আতাউর ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ঢাকা-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকার কারণে স্বাধীনতার পর গ্রেফতার হয়ে কয়েক মাস কারাভোগ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় লীগের হয়ে ঢাকা-১৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার প্রতীক ছিল লাঙ্গল।
আতাউর রহমান খান এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বাদীন ৭ দলীয় জোটের শীর্ষ স্থানীয় নেতা ছিলেন। সেসময় বায়তুল মোকারমের এক জনসভায় জেনারেল এরশাদকে ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করার পরদিনই সামরিক সরকারের পাপেট প্রধান মন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান। সেই বিব্রতকর অবস্থায় সাংবাদিকদের প্রশ্ন উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আসুন আমরা গণতন্ত্র রক্ষা করি।’ কিন্তু তিনি নিজেকেই রক্ষা করতে পারেনি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানালে জেনালের এরশাদ তার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ফলে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান। একই সঙ্গে রাজনীতিতে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন আতাউর রহমান খান। এবং মূল ধারার রাজনীতিতে আর ফিরতে পারেননি। এ অবস্থায় ধানমন্ডীর বাসায় অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আমৃত্যু সময় পার করেছেন আতাউর রহমান খান।
উল্লেখ্য, আতাউর রহমান খান ঢাকার ধামরাই উপজেলার বালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৪ সালে ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (এসএসসি সমতুল্য) পাস করেন। ১৯২৭ সালে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এফএ (এইচএসসি সমতুল্য) এবং ১৯৩০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক পাস করেন। পরে ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন আতাউর রহমান খান। তিনি খুবই উচ্চমানের লেখক ছিলেন। তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। তবে তার জীবনের শেষ শেষ লেখা ‘মানুষ অমানুষ’ বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
Post Views: ২৩০