Home ফিচার হালের লাঙ্গল-গরু কেবলই ছবি: পাওয়ার টিলার কৃষকের গলার ফাঁস!

হালের লাঙ্গল-গরু কেবলই ছবি: পাওয়ার টিলার কৃষকের গলার ফাঁস!

করোনা মহামারির কারণে বিরাজমান ভয়াবহ সংকট বিবেচনায় খাদ্য উৎপাদনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ গুরুত্বারোপ খুবই সঙ্গত। এবং এ রকম গুরুত্বারোপ বর্তমান সরকার শুরু থেকেই করে আসছে। যার সূচনা করেছে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার সরকার গঠন করার পর থেকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। এবার করোনা মহামারি পরিস্থিতে খাদ্য উৎপাদনের উপর যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে আশাবাদী হতেই হয়। কিন্তু হতাশা অন্যখানে। ধানের জমি চাষ হবে কি দিয়ে? খবর নিয়ে জানাগেছে, কেবল অলাভজনক হয়ে পড়া নয়, চাষ দেয়ার উপকরণের অভাবেও ধান চাষ উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। এক সময় যে চরের ধান নিয়ে প্রভাবশালীদের মধ্যে যুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হতো, হতাহত হতো অনেক। সেই চরে বহু বছর ধরে ধান চাষ হয় না। কিছু জমিতে কিছুকিছুু মওসুমী ফসল চাষ হয়। বাকী কেবল ধুধু বালু চর। সেতুর প্রভাবে পদ্মার চর যেমন! জমি অনাবাদী থাকার চিত্র কম বেশি গোটা দেশেরই। বরিশালে এই চিত্র ভয়াবহ!

প্রধানত, ধানের মূল্য না পাওয়ায় ধান চাষ কমেছে। এর পিছনেরও মাফিয়া চক্কর আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাষের উপকরণের অভাব এবং কর্তনে শ্রমিক না পাওয়া। ধান কাটার সময় শ্রমিক না পাওয়ার বিষয়টি আলোাচনায় আসছে কয়েক বছর ধরে। এ বিষয়ে ফটো সেশনও হয়। এবার এ চক্করে অনেক কৃষকের ধানের বারোটা বেজেছে। ধানকাটা নিয়ে শ্রমিক সংকটের ডামাডোলে জমি চাষ করার জন্য উপকরণের সংকটের বিষয়টি রয়ে যায় আড়ালেই। হয় তো এ ক্ষেত্রে মাফিয়া সর্বনামের ষোলকলা পূর্ণ হয়েগেছে। এ নিয়ে মাফিয়াদের ভাবার আর কিছু নেই। এখন কেবল ধান কাটা মেশিন কৃষকের গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারলেই হলো। যেমনটা করা হয়েছে ট্রাকটর ও পাওয়ার টিলারের বেলায়। যা বহু আগে কৃষকের গলার ফাঁস হয়েগেছে। এদিকে হালের লাঙ্গল-গরু হয়েগেছে কেবলই ছবি!

জমি চাষের জন্য ট্রাকটর ততটা বাজার না পেলেও সরকারী প্রচারণায় পাওয়ার টিলার কৃষকের ঘরে ঘরে পৌছে গিয়েছিলো। আর কেবল প্রচারণা নয়, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের নামে পাঁচ বছর মেয়াদে এক প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩৫ হাজার পাওয়ার টিলার কৃষকদের হাতে পৌছানো হয়েছে। বেশিরভাগ দেয়া হয়েছে বিনা মূল্যে, আর বাকিটা দেয়া হয়েছে নামমাত্র মূল্যে। ৭০ শতাংশ ভতুর্কী দিয়েছে সরকার। এ সময় অনেক মুখরোচক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই এগুলো ভাঙ্গারীর দোকানে চলে গেছে। আর এ জন্য সরবরাহকারীদেরও দোষ দেবার উপায় নেই আইনের দৃষ্টিতে। কারণ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে এর মেয়াদও ছিলো দুই বছর। কি অদ্ভূত চুক্তি। এরপর খেল খতম পয়সা হজম!

এদিকে বিপদে পড়েছেন প্রান্তিক কৃষকরা। ২০১৪-১৯ সাল, পাঁচ বছর মেয়াদে প্রকল্পের অধীনে বিনা মূল্যে এবং নাম মাত্র মূল্যে কৃষকদেরকে দেয়া প্রায় ৩৫ হাজার পাওয়ার টিলার দুই বছরের মধ্যেই ‘মায়ের ভোগে’ চলে গেছে! এর গন্তব্য ভাঙ্গারীর দোকান। বাতিল রিকসা-সাইকেলে সঙ্গে সহঅবস্থান। এ নিয়ে অবশ্য তেমন কোন ক্ষোভ ধূমায়িত হয়নি। কারণ সরকারী পাওয়ার টিলারের বেশির ভাগই গেছে টাউট শ্রেনীর হাতে। তারা যা পেয়েছে তাতেই খুশি। কিন্তু সর্বনাশ হয়েছে ধানচাষ ব্যবস্থাপনার। এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবার আগেই সরকারের পাওয়ার টিলার সরবরাহ ‘সমাপ্ত’ হয়েছে। এ নিয়ে আছে নানান অনিয়মের অভিযোগ। অবশ্য এই প্রকল্পের এক কর্মকর্তাকে সম্প্রতি সড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

যান্ত্রিক চাষের অতি প্রচারণা এবং চকচকে ‘মেশিন গরু’-এর মোহে হাজার বছরের চাষের লাঙ্গল-গরু হয়েছে অবহেলিত। কৃষকের প্রবনতা পাল্টে গেছে। হালের বলদ চলে গেছে কসাইর কাছে। বাকী যায় কুরবানীর হাটে। এই সুযোগে বাজার ছেয়ে গেছে নিন্মমানের পাওয়ার টিলারে। সরকারী প্রচারণায় হালের বলদ ছেড়ে যারা বাজার থেকে পাওয়ার টিলার কিনেছেন তারা আছেন মহা বিপদে। কারণ এগুলো সঠিকভাবে কাজ করে না। আর একটি ছাড়া আর কোন কোম্পানী পাওয়ার টিলারের কোন ওয়ারেন্টি দেয় না। বাজার থেকে পাওয়ার টিলার কিনে বিপাকে পড়া কৃষকদের ব্যাপারে দৈনিক ইত্তেফাকে ২০১৮ সালের ৭ মার্চ একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক ভয়াবহ।

আধুনিক পদ্ধতিতে যান্ত্রিক চাষ করার প্রচারণার ফাঁদে পড়ে নিম্ন মানের পাওয়ার টিলার কিনে কৃষকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক ডিলার পাওয়ার টিলার বিক্রি করার পরে বিক্রয়োত্তর সেবা দেয় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব পাওয়ার টিলারের যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকরা আছেন চরম সংকটে। প্রায় সারা দেশের কৃষকরাই একই অবস্থায় মধ্যে রয়েছে। পাওয়ার টিলার বিক্রয়ের পর কোম্পানিগুলো আর বিক্রয়োত্তর সেবা দেয় না। ফলে মুনাফার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে নানান ঝাক্কি। ঘনঘন চেইন ও গিয়ার বক্স পরিবর্তন করতে হয়। তাছাড়া অনেক সময় যন্ত্রাংশ খোলা বাজারে পাওয়া যায় না। এদিকে কম দামের ফাঁদেও পড়ছেন কৃষকরা। দাম কম বলে যেগুলো কৃষকদেরকে গছিয়ে দেয়া হচ্ছে সেগুলোর জ্বালানী খরচ অনেক বেশি। অন্যদিকে এর চেইনও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। কিছুদিন পরই চেসিসটি পরিবর্তন করতে হয়। ফলে সস্তায় পাওয়ার টিলার কিনে কৃষকরা পড়েছেন তিন অবস্থায়!

উল্লেখ্য, বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি বিভাগের যৌথ জরিপের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ব্যবহার্য পাওয়ার টিলারের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। বছর প্রায় ৫০ হাজারের বেশি পাওয়ার টিলার আমদানি করা হচ্ছে। পাওয়ার টিলারের বাজারে ৭০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে চিটাগাং বিল্ডার্স লিমিটেড। এই মনোপলির বিষয়টিও রহস্যজনক।

কৃষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের অব্যাহত গুরুত্বারোপ, মতিয়া চৌধুরীর মতো দক্ষ মন্ত্রী দশ বছর কৃষিমন্ত্রণালয় চালাবার পর বর্তমান মেয়াদে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়েছে ড. আবদুর রাজ্জাককে। যিনি নিজে কৃষিবিদ এবং ২০০৮-এ আওয়ামী সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। কৃষিমন্ত্রী হিসেবে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। আর তাঁর সততা এখনো মাইল ফলক হয়ে আছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। অথচ এ মন্ত্রণালয় সেই আদিকাল থেকেই দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত। সেই মন্ত্রণালয়ের ইমেজ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছিলেন ড. রাজ্জাক। এদিকে কৃষি সচিব মো: নাসিরুজ্জামানের সততা ও দক্ষতা সুবিদিত। তা না হলে আর যাই হোক, মতিয়া চৌধুরী তাঁকে কৃষি সচিব হিসেবে গ্রহণ করতে চাইতেন না। আর বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাকও তাকে রাখতে অনীহা প্রকাশ করতেন। কিন্তু এমনটা হয়নি। বরং দুজনই বর্তমান কৃষি সচিবকে আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করেছেন। শুধু তাই নয়, অনেকেই কৃষি সচিব মো: নাসিরুজ্জামানকে কৃষিবিদ মনে করেন। উল্লেখ্য, তিনি কৃষি সেক্টরে কাজ করছেন একটানা প্রায় ছয় বছর।

কৃষিখাতে নানান সীমাবদ্ধতার পরও স্বীকার করতেই হবে, জাতি ও দেশের কৃষির ভাগ্য ভালো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। এবং মতিয়া চৌধুরী ও ড. আবদুর রাজ্জাককে কৃষিমন্ত্রী করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে কৃষির অবস্থা হতো আদমজী জুট মিলের মতো। বিএডিসি দিয়ে যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলো খালেদা সরকার। এরপরও কথা হচ্ছে, কৃষিতে বিশ্ব মাফিয়াদের আগ্রাসন প্রতিরোধের বিষয়টি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন। মাফিয়ারা কিন্তু বাংলাদেশের কৃষিকে অনেকখানি খামচে ধরে আছে। জীবনান্দ দাশের কবিতার ‘দুরন্ত এক শকুনের মতো!’

দখিনের সময় / আলম রায়হান (জেষ্ঠ্য সাংবাদিক) 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

এক-তৃতীয়াংশ ইহুদি-আমেরিকান কিশোর হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল

দখিনের সময় ডেস্ক: এক-তৃতীয়াংশের বেশি আমেরিকান-ইহুদি কিশোর (১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী) 'আমি হামাসের সাথে সহানুভূতিসম্পন্ন'- এমন বক্তব্যের সাথে একমত। ইসরাইলের একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে...

প্রতিদিন কলা খাওয়ার উপকার

দখিনের সময় ডেস্ক: প্রতিদিন কলা খেলে মেলে অনেক উপকার। কলায় থাকে প্রয়োজনীয় অনেক ভিটামিন। যে কারণে চিকিৎসকেরা নিয়মিত কলা খাওয়ার পরামর্শ দেন। প্রতিদিন অন্তত দুটি...

মোহিনীর প্রেমের এআর রহমানের বিচ্ছেদ, যা বলছেন পুত্র

দখিনের সময় ডেস্ক: ব্যক্তিজীবন নিয়ে সংবাদের শিরোনামে এআর রহমান। সায়রা বানুর সঙ্গে দীর্ঘ ২৯ বছরের দাম্পত্যের অবসান। বুধবার রাতে রহমানের স্ত্রী সায়রার আইনজীবী এই খবর...

স্মার্টফোনে ইন্টারনেট চলে যাচ্ছে? জেনে নিন গতি বাড়ানোর কৌশল!

দখিনের সময় ডেস্ক: অনেকেই মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় হঠাৎ করেই দেখেন, নেটওয়ার্ক চলে গেছে। আশেপাশের অন্যরা নির্বিঘ্নে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারলেও আপনার ফোনেই সমস্যা...

Recent Comments