কুমিরের কান্নাকে লোক দেখানো কান্নার সঙ্গে তুলনা করা হয়। অর্থাৎ কোনো ঘটনায় শোকাহত না হয়ে বা কষ্ট না পেয়ে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কান্না করাকেই কুমিরের কান্না বলা হয়। কিন্তু কুমির কি সত্যিই কাঁদে? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার। কুমিরের কান্না নিয়ে বিভিন্নজনের গবেষণা ও পর্যবেক্ষণকে সন্নিবেশ করেছে তারা। কুমির কি খেতে খেতে কাঁদে? এ বিষয়টি প্রথম চোখে পড়েছিল জন ম্যান্ডেভিলের। আজ থেকে প্রায় ৯০০ বছর আগে। সে কথা নিজের ভ্রমণ বিবরণীতে লিখে রেখে গিয়েছিলেন তিনি।
ম্যান্ডেভিলের পরিচয় ভালো ভাবে জানা যায় না। বই পড়ে শুধু জানা যায়, অদ্ভুত সব জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। তার বইয়ের নাম ‘দ্য ভয়েজ অ্যান্ড ট্র্যাভেল অফ স্যর জন ম্যান্ডেভিল’। ফরাসি ভাষায় সেটি প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৫৬-৫৭ সালে। ইংরেজি ভাষায় বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭৫ সালে। সেই বইয়ের এক জায়গায় লেখা হয়েছিল, ‘ওই দেশে রয়েছে অনেক কুমির। সেগুলো মানুষ ধরে আর কাঁদতে কাঁদতে খেয়ে ফেলে।’
ম্যান্ডেভিলের মতোই গ্রিক দার্শনিক প্লুটার্কেরও কুমিরের কান্না চোখে পড়েছিল। সেই প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীতে। নিজের বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, মানুষ খাওয়ার সময় চোখ দিয়ে পানি পড়ে কুমিরের। পরে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারও নিজের বেশ কিছু লেখায় এর উল্লেখ করেন। তা হলে কি সত্যিই কাঁদে কুমির? অষ্টাদশ শতাব্দীতে সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানী জোহান জেকব সিদ্ধান্তে পৌঁছান, মাংস খাওয়ার সময় কুমির মোটেও কাঁদে না।
তার ২০০ বছর পর আরও এক বিজ্ঞানী জর্জ জনসন কুমিরের ওপর একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। কুমিরের চোখে লবণ ও পেঁয়াজ ঘষে দিয়েছিলেন তিনি। দেখা যায়, তার পরেও চোখ থেকে এক ফোঁটাও পানি পড়েনি কুমিরের চোখ থেকে। তার মতে, কুমিরের কান্না একটা ‘মিথ’। ১৯২৭ সালে এক বিজ্ঞান পত্রিকায় সেই বিষয়টি প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে স্নায়ুবিদ ম্যালকম শেনার এবং প্রাণিবিদ কেন্ট এ ভ্লিয়েট আরও একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনটি আমেরিকান অ্যালিগেটর, দুটি কেম্যান, দুটি ইয়াকার কেম্যানকে অ্যালিগেটর পার্কের শুকনো জমির ওপর খেতে দেওয়া হয়েছিল। আশপাশে কোনো জলাভূমি ছিল না। এরা সবাই কুমিরের জাতভাই।
পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, একটি ইয়াকার কেম্যান এবং একটি সাধারণ কেম্যান ছাড়া খাওয়ার সময় বাকিদের চোখে পানি। এমনকি খাওয়ার পরেও তাদের চোখে পানি দেখা গিয়েছিল। সেই পরীক্ষা থেকে শেনার এবং ভ্লিয়েট সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, খাওয়ার সময় কমবেশি সব কুমিরই কাঁদে।
কিন্তু কেন কাঁদে? বিজ্ঞানী শেনার এবং ভ্লিয়েটের মতে, কুমির যখন চিবিয়ে খায়, তখন চোয়ালের ওঠা-নামার কারণে তার সাইনাসে হাওয়া ঢুকে যায়। এর ফলেই কুমিরের চোখের অশ্রুগ্রন্থি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে আবেগ, শোক বা অনুশোচনার কোনো সংযোগ নেই। খাওয়ার সময় মানুষও কি কাঁদে? বিজ্ঞানীরা বলেন, কাঁদতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। একে বলে ‘ক্রোকোডাইল টিয়ার সিনড্রোম’। বেলস পালসি থেকে সেরে ওঠা রোগীদের ক্ষেত্রে এ রকম দেখা যায়।
বেলস পালসি হলে মানুষের মুখের পেশি দুর্বল হয়ে যায় বা পক্ষাঘাত হতে পারে। মুখের পেশিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে যে স্নায়ু, তা স্ফীত হলে বা চেপে গেলে এই অবস্থা দেখা যায়।