কলেজ জীবনের আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে জালাল। সহজ-সরল এবং আবেগী বন্ধু আমার প্রায়ই বলতো, ‘প্রেম কখনো মরে না, অন্তরালে যায় মাত্র।’ এটি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা নাকি কারো কাছ থেকে ধার করে বলতো তা জানি না। এদিকে যমুনা টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় টক শো’র চৌকস এ্যাংকর বিরতিতে যাবার সময় বলেন, ‘রাজনীতিতে বিরতি নেই, ফিরছি একটু পরে।’ অংশগ্রহনে হাটবাজার বসানোর মতো এই অনুষ্ঠানের নামও ‘রাজনীতি।’ আসলেই তাই রাজনীতিতে কথানো বিরতি হয় না। বন্ধু জালালের ভাষায় প্রেম যেমন মরে না, তেমনই রাজনীতিরও মৃত্যু নেই। রাজনীতি অন্তরালে যায়, আন্ডারগ্রাউন্ডেও যায়। নেতারা পালায়। তবে পালানোর ক্ষেত্রে সম্ভবত বিশ্বর রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবং তার সাংগাতরা। কিন্তু এই পলায়নই কী শেষ কথা? মনে হয় না। সঙ্গত কারণেই ঘুরে দাড়াবার পথ খুজঁছে পলাতক আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে কোন তরিকায়? এটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।
প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করাযেতে পারে, দলে নবাগত কর্মী-সমর্থকদের হাইব্রিড ও কাউয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন ওবায়দুল কাদের। এ কারণে তিনি ‘কাউয়া কাদের’ আখ্যা পেয়েছেন। এদিকে বছর কয়েক আগে আলোচিত শামীম ওসমান বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘পাতায় পাতায় আওয়ামী লীগ।’ মানে জমিন ছাড়িয়ে গাছ-কান্ড হয়ে অতপর পাতায় পৌঁছেছে দলটি। এদিকে পাতায় পাতায় সেই অওয়ামী লীগ এখন পাতালে! পালের গোদাসহ সবাই পালিয়েছে। এক সময় পাড়া-মহল্লার আওয়ামী লীগ অফিসও গমগম করতো। এখন কবরের নীরবতা বিরাজমান। এই অবস্থা কমবেশি সারাদেশেই। দলটির বেশিরভাগ নেতা-কর্মী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এদের মধ্যে কেউ পালিয়ে আছেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কেউ পলাতক বিদেশে। বাকিদের অনেকে কারাগারে। কেউ আবার এলাকায় আছেন স্থানীয় বিএনপির পিছনে টংকা খরচ করে। মূলত বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ। প্রকাশ্যে নেই নেতা-কর্মীরা, দলীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বা নির্দেশনাও নেই তৃণমূলে। কিন্তু এ অবস্থায় ১৭ জানুয়ারি বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে বলেছে, “আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলটির সব স্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বসতে যাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। উদ্দেশ্য নেতা-কর্মীদের সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করে তোলা। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলছেন, অচিরেই দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেয়া হবে। ধাপে ধাপে কর্মসূচিতে হরতালের কথাও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।”
এদিকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মাঠ গরম করার একটি প্রয়াস সম্প্রতি অধিকতর জোরালো হয়েছে। যেমন জামায়েত আমীর ডা. শফিকুর রহমান ৫ আগস্টের পর প্রকারন্তরে গৌতম বুদ্ধের মতো আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেবার কথা বলেছিলেন। সেই নেতাই ১৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘কাশিমপুরে আসুন, ভালো জায়গা দেব।’ একই দিন গণ-অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘গণহত্যার বিচারের আগে আওয়ামী লীগ কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।” অবশ্য এর আগের দিন ১৬ জানুয়ারি মহা জোশে কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ থাকবে, না হয় আমরা থাকব!’ আওয়াজ দেয়ার ধারা থেকে পিছিয়ে নেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বরিশালে ভাষায় ‘কুক দেবার’ মতো ১৫ জানুয়ারি তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপোস করার কোনো সুযোগ নেই ।’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ১৫ জানুয়ারি থেকে এই সব গরম কথার তাৎপর্য আছে।
এদিকে প্রকাশিত খবর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পলাতক আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং করবেন। এবং নানান কর্মসূচি দিবেন। কিন্তু এমনটি করলেই কী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা ‘ইয়া আলী’ বলে মাঠে নেমে পড়বে? নাকি কাছাকাছি সময়ে রাজনীতিতে কোন সূফল পাওয়া যাবে? উত্তর নেতিবাচক বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ প্রধানত দুইটি। এক. জনগণের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের অবস্থা অনেকটা মুখপোড়া হনুমানের মতো। দুই. রাজনীতির মাঠ আওয়ামী লীগের জন্য খুব্ই বৈরী। অন্য কোন রাজনৈতিক দলের জন্য পরিস্থিতি এতোটা বৈরী হবার উদাহরণ বিরল। এমনকী শীর্ষ কয়েক নেতা ফাঁসীর দড়িতে ঝোলার পরও জামায়াতের জন্যও মাঠের রাজনীতি এতোটা বৈরী ছিলো না, যতটা এখন বিরাজমান আওয়ামী লীগের জন্য। কারণ, জামায়ত নেতারা ভারত প্রভাবিত হয়ে ক্ষমতাসীনদের নিষ্ঠুর বলী হয়েছেন। কিন্তু জনগণ ছিলো সহানুভূতিশীল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অবস্থান একবারে তলানীতে।
আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে তুনমূলের ক্ষোভ এবং মাজুল দশা। তৃনমূলের প্রায় সকল নেতা-কর্মী, এমন কী সমর্থকও ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দলের কেউ তাদের খোজ খবর নেয় না, তাদের কাছেও কোন খোজ খবর নেই। এদিকে দলের তৃনমূলের ধারণা, ‘দলের শীর্ষ নেতারা ভারতে আরাম আয়েশে আছেন। যেমন ছিলেন ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বর্তমান অবস্থা থেকে খুব সহসা আওয়ামী লীগের উত্তর কেবল কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব। আর সতসিদ্ধ কথা হচ্ছে, তৃনমূল ছাড়া হানাহানির রাজনীতি জমানো যায় না। কাজেই আওয়ামী লীগের অদূর ভবিষ্যত মোটেই আলোকিত নয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ মধ্যে যদি ডাকসু এবং অন্যান্য বিদ্যাপিঠের ছাত্র সংসদ এবং স্থানীয় সররকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা বিএনপি যেমন বেকায়দায় পড়বে তেমনই শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাড়ানোর সম্ভাবনা সোনার পাথরবাটি।
প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীনও। তার মতে ‘গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দল হিসেবে জনগণের মুখোমুখি কীভাবে হবে সেটা হচ্ছে দলটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মানে কী কৌশল নিয়ে দাঁড়াবে, কী বার্তা নিয়ে দাঁড়াবে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়াবে এবং কী কর্মসূচি নিয়ে দাঁড়াবে। আবার জনগণের সামনে আসলেও জনগণ তাদের বার্তাকে কীভাবে নেবে এগুলো এখনও অনিশ্চিত।’ অবশ্য চিয়ায়ত একটি বয়ায়ান আছে, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই!’ দেখা যাক রাজনীতির পানি কোথা থেকে কোথায় গিয়ে গড়ায়!