Home অন্যান্য নির্বাচিত খবর বরিশালের পশ্চিমে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদার

বরিশালের পশ্চিমে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদার

আলম রায়হান:

বরিশাল শহরের পশ্চিমে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন তৎকালীন ইপিআর-এর সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদার। তখন এলাকাটি ছিলো নিতান্তই অজপাড়াগাঁ। একটি ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়েছিলো।

যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করতে বঙ্গবন্ধুর আহবানের সাড়ামেলে বরিশালের অজপাড়াগায়েও। দেশের অন্যান্য এলাকার মতোই রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নে বাঁশকে রাইফেল হিসেবে ধরে নিয়ে সর্বসাধারণের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন বারেক ভূইয়া তিনি ছিলেন সমাজকর্মী ও উচ্চ শিক্ষিত।

এদিকে বরিশাল সদর উপজেলার ১নং রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের পশ্চিম শোলনা গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সূচনা কে সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদার। রন । এরপর তিনি ৭নং পশ্চিম শোলনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প স্থাপন করেন। পরে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর শাজাহান ওমরের বিশেষ আগ্রহে ঝালকাঠির বেইস কমান্ডার নিযুক্ত হন সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদার। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পদ ছিলো ডিফেন্স চীফ।

সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদার প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পটিই ছিলো বরিশাল শহরের পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ক্যাম্প। এ ক্যাম্প দেখে বরিশালের আর এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খান বাবুগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরপর দ্রুত বরিশালে একাধিক ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে মেজর জলিলের ৯নং সেক্টরের নেতৃত্ব লাভ এবং মেজর শাজাহান ওমর সাবসেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হবার পর গোটা বরিশাল অঞ্চল হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের দুর্জয় ঘাটি। এমনকি, ‘আক্রমনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা রেকি করে গেছে’- এই খবরে থানার পুলিশ-রাজাকার এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার ঘটনাও ঘটেছে একাধিক।

সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদার একাত্তর সালের ২৫ মার্চের পর ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। এ সময় তিনি অস্ত্রের এক ব্যাগ অস্ত্রের যন্ত্রাংশ সঙ্গে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, অস্ত্র চালানোর পাশাপাশি তিনি অস্ত্র মেরামতে পারদর্শী ছিলেন। বাড়িতে আসার পর করণীয় বিষয়ে তিনি কিছুটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এলাকার মানুষকে যুদ্ধে কতটা সম্পৃক্ত করা যাবে তা নিয়ে তাঁর মধ্যে এক রকমের অনিশ্চয়তা ছিলো। তার এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটতে ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে তাঁর বাড়িতে ডাকাতির অপচেষ্টার ঘটনা।

মজিবুল হক সরদারে গ্রামের বাড়িতে দোতলা বিল্ডিং ছিলো। এটি নির্মিত হয়েছিলো ১৯৬০ সালে। একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ বাড়িতে ডাকাতরা হানা দেয়। সেসময় ডাকাত দলে এক থেকে দেড়শ’ সদস্য থাকতো। এবং তারা একরাতে গ্রামের ২৫ থেকে ৩০টি বাড়িতে ডাকাতি করতো। সেবার মজিবুল হক সরদারের বাড়ি দিয়ে ডাকাতি শুরুর পরিকল্পনা করে ডাকাত দল। এদিকে গোলমেলে পরিস্থিতি এ রকম ঘটনা ঘটার আশংকায় কৌশলগত ব্যবস্থা নিয়া রাখা হয়েছিলো। যা ডাকাত দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। বাড়িতে কৌশলী অবস্থান এবং ইপিআর-এর সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদারের অস্ত্রচালনায় দক্ষতা এবং পুত্র ফজলুল হক সরদারসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহায়তায় সেদিন অসম যুদ্ধেও মজিবুল হক সরদারের বিজয় হয়। রাত ১২টার দিকে অন্তত ২২টি রাইফেলসহ প্রায় দেড়শ’ সদস্যের ডাকাত দল হামলা করলেও প্রতিরোধের মুখে রাত দুইটার দিকে রণে ভঙ্গ দেয়। এ সময়ের মধ্যে তিন ডাকাত নিহত ও ৮ ডাকাত গুরুতর আহত হয়। আহতদের মধ্যে দুইজন ছিলো ডাকাত সর্দারের সহোদর। এদের বাঁচানোর জন্য ডাকাতরা নিহত ও আহতদের নিয়ে যাবার শর্তে চলে যেতে চাইলো। বাস্তবতার আলোকে এই শর্ত মেনে নেন মজিবুল হক সরদার।

ডাকাত দল ব্যর্থ হয়ে চলে যাবার পর ভোর হতে না হতেই মজিবুল হক সরদারে বাড়িতে মানুষের ঢল নামে। দেখতে দেখতে জনতার সংখ্যা তিন-হাজারে গিয়ে পৌছায়। তখন এখানে-ওখানে রক্ত এবং অসংখ্য গুলির খোসা। এদিকে সারা এলাকায় ছড়িযে যায়, ‘মেজর সাহেবের বাড়িতে ডাকাত মেরেছে।’ বিষয়টি অন্য রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অনেকেই সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদারকে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেবার অনুরোধ জানান। মানুষের আগ্রহ দেখে তিনিও আস্থা পান। এদিকে ২৪ এপ্রিল বরিশালে পাকবাহিনীর প্রবেশে বাধা প্রদানের যুদ্ধে পিছুহটার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই অস্ত্র খালে ফেলে যায়। সেইসব অস্ত্রের মধ্যে তিনটি অস্ত্র নিয়ে লুৎফর রহমান মিয়া, ফজলু দফাদার, নূর মোহাম্মদ তালুকদার ও ছালম কেরানী একদিন মজিবুল হক সরদারের বাড়িতে আসেন। প্রায় অকেজো সেই অস্ত্র মেরামত করা হয়। এর সঙ্গে আরো দুটি যোগ হয়ে মোট অস্ত্রের সংখ্যা দাড়ায় পাঁচ। এ অস্ত্রের উপর ভরসা করেই গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। এরপর মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করা শুরু হয়। এ অবস্থায় বরিশালের ন্যাপ নেতা আরব আলী একদিন মজিবুল হক সরদারের বাড়িতে এসে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরেন। এরপর ৭নং পশ্চিম শোলনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। সেখানে ৬/৭ দিন ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র ট্রেনিং চলে। পরে এ ক্যাম্পকে বেইস কমান্ডার হিসেবে যোগদেন সুলতান মাস্টার।

মেজর শাজাহান ওমর ৯নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করার পর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বড়াকোটায় ডাকেন। এখানে তিনি সকলের সঙ্গে পরিচিত হন। সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদারের পরিচয় পেয়ে তার প্রতি তিনি বিশেষ আগ্রহী হন মেজর শাজাহান ওমর। সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদারকে নিজের  সঙ্গে সংযুক্ত করেন মেজর শাজাহান ওমর। পরে তাঁকে ঝালকাঠির বেইস কমান্ডার, তথা ডিফেন্স চীফ নিয়োগ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে ঝালকাঠির সকল অস্ত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমাদেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদার। মুক্তিযুদ্ধে তার আহত হবার বিষয়টি গেজেটভুক্ত হয় ২০১৩ সালে। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো ভাতা পাননি বীর এই মুক্তিযোদ্ধা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

বিআরইউ’র সভাপতি আনিসুর, সম্পাদক খালিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির (বিআরইউ) সভাপতি আনিসুর রহমান খান স্বপন (নিউ এইজ / ঢাকা ট্রিবিউন) আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন খালিদ সাইফুল্লাহ (নয়া...

চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জল

দখিনের সময় ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের গণপিটুনিতে নিহত মাসুদ কামাল তোফাজ্জলের জানাজা শেষে বরগুনার পাথরঘাটায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে...

অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর গ্রেফতার

দখিনের সময় ডেস্ক: চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) তাকে আটক করা হয়। নিউমার্কেট থানার...

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ

দখিনের সময় ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম...

Recent Comments