ঘটনাচক্রে বেঁচেযান ৬০/৭০ মুক্তিযোদ্ধা, মাঝির খবর কেউ রাখেনি!
দখিনের সময়
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৯, ২০২০, ০৯:০৩ পূর্বাহ্ণ
সংবাদটি শেয়ার করুন...
আলম রায়হান ॥
সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদারের উদ্যোগে বরিশাল সদর উপজেলার ১নং রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নে ৭নং পশ্চিম শোলনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে সদস্য সংখ্যা দ্রুত ৬০/৭০ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ক্যাম্পটি শিবপাশার হাজী রজ্জব আলীর বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। বিশাল এই বাড়িতে স্বাচ্ছন্দে অবস্থান করছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু এটি ছিলো আসলে তাদের জন্য এক মৃত্যুকুপ! ঘটনা চক্রে এ মৃত্যুকুপ থেকে বেঁচে যান মুক্তিযোদ্ধারা।
হাজী রজ্জব আলীর ছেলে জাফর খান ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষের লোক। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের এই ক্যাম্প হামলার জন্য পাকহানাদার বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেন। এবং বড় অপারেশনের দিন-তারিখ নির্ধারিত হয়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পাঠান মেজর শাজাহান ওমর ভারত থেকে আসা অস্ত্র গ্রহণ করার জন্য যেতে বলেছেন। তখন বৌসের হাট সংলগ্ন খালে ঝালকাঠি-সুবিদখালী রুটে ছোট লঞ্চ চলাচল করতো। এই লঞ্চে করে অস্ত্র আনতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ জন্য হাজী রজব আলীর বাড়ির ক্যাম্প থেকে একটি নৌকায় করে রাতে কয়েক ট্রিপে মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চে ওঠেন। এদিকে ঐদিন ভোর রাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে হামলা চালায় পাকবাহিনী। কিন্তু তখন ক্যাম্প ছিলো মুক্তিযোদ্ধা শূন্য। ফলে সেদিন ঘটনাচক্রে ৬০/৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু পাকবাহিনীর হামলা থেকে রক্ষা পায়নি মুক্তিযোদ্ধারে পারাপার করা নৌকাটি। একই সময় সুবেদার মেজর মজিবুল হক সরদারের বাড়িতে মর্টার সেল নিক্ষেপ করে পাকিস্তানী হানাদাররা।
একাধিক ট্রিপে মুক্তিযোদ্ধাদের লঞ্চে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরতে মাঝির দেরী হয়ে যায়। এদিকে রাত গভীর হবার পরও স্বামী বাড়ি না ফেরায় মাঝির স্ত্রী স্বামীর জন্য ভাত নিয়ে কিশোর পুত্রসহ নৌকাঘাটে আসেন। তখন হাজী রজ্জব আলীর বাড়িতে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাক বাহিনীর অপরেশন চলছে। থাকার জন্য জালানো নৌকায় কুপি জালানো হয়। এই আলো লক্ষ গুলি ছোড়ে পাক বাহিনী। এতে ঘটনাস্থলেই মাঝির কিশোর পুত্র নিহত হয়। আহত মাঝির স্ত্রী। সে মারা যায় কয়েকদিন পর। সেদিন প্রাণে বেঁচে থাকলেও স্ত্রী-পুত্র হারানোর শোকে পাগল হয়ে যান নৌকার মাঝি মহাম্মদ আলী কারীকর। এরপর তিনি বহুদিন বরিশাল শহরে ঘোরার পর এক পর্যায়ে মারাযান। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কোন স্বীকৃতি মেলেনি আজও!
নৌকার মাঝি মহাম্মদ আলী কারীকরের জীবিত দুই কন্যা এখনো জীবিত আছেন। এদের একজনের সন্ধান পাওয়াগেছে। এসে এখন বরিশাল সদর উপজেলা অফিসের সামনের ফুটপাথে চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহত করছেন। কেউ তার খবর রাখে না!
শুরু হয় ঢাকা দখলের লড়াই
একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সামনে শুধু ঢাকা দখল লড়াই। সবদিকে দিয়ে মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাইরে থেকে হানাদার বাহিনীর প্রবেশ রুদ্ধ হয়ে যায়। মিত্রবাহিনী একে একে আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাঁদপুর ময়মনসিংহ দখলে নিয়ে নেয়। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
একাত্তরের এদিন সকালে হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে প্রথমবারের মতো জেনারেল নিয়াজী স্বীকার করেন, পরিস্থিতি নিদারুণ সংকটপূর্ণ। আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারণে পুনর্বিন্যাসকরণ সম্ভব নয় বলে একটি সাংকেতবাণীও পাঠানো হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। দ্রুত মুক্ত হতে থাকে একের পর এক জায়গা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য পাকিস্তনের সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার পদক্ষেপ নেয়। আজকের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হতে আদেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিলো, মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দেয়া। কিন্তু উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কারণ বীর সন্তানদের মনোবল ভেঙে দেয়া মোটেও সহজ কাজ নয়।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে যে জায়গাগুলো শত্রুমুক্ত হয়, তাদের অন্যতম হলো দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোণা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা। দাউদকান্দি শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এর আগে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।