• ২৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পুরো একমাস বরিশাল ছিলো মুক্তাঞ্চল

দখিনের সময়
প্রকাশিত এপ্রিল ৬, ২০২২, ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ
পুরো একমাস বরিশাল ছিলো মুক্তাঞ্চল
সংবাদটি শেয়ার করুন...

১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙ্গালীদের বিপুল বিজয়ের পর চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র শুরু করে সামরিক বাহিনী প্রভাবিত পাকিস্তানের শাসকচক্র। ৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সর্বশক্তি নিয়ে ঢাকাবাসীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে পাক সেনারা। আক্রমনের এ ধারা শুরু হয়েছিলো ফেব্রুয়ারী মাসেই।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারক ঢাকা ছেড়ে পলায়নের পর কার্ফিওর মধ্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মালিবাগ রেললাইন বস্তিতে হামলা চালায়। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। বস্তিবাসী আর্মিকে প্রতিহত করেদেয়। এ সময় কয়েকজন সেনা সদস্য নিহত হয় বলেও জনশ্রুতি আছে। জনতার এই প্রতিরোধের ছায়া পড়ে গোটা ঢাকা শহরে। এর প্রভাবে ১৮ ফেব্রুয়ারী থেকে ঢাকাশহর সেনা শূন্য হয়ে যায়। তারা আশ্রয় নেয় কান্টমেন্টে। এমনকি অবাঙ্গিলীদের অনেক ব্যবসাকেন্দ্র-দোকান বন্ধ হয়ে যায়। অনেক অবাঙ্গালী আশ্রয় নেয় ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি স্থানে।

তখন ঢাকার মানুষ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধমুখী। কিন্তু চুড়ান্ত আঘাতের সময় ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ছাড়া আর কোথাও প্রতিরোধ প্রয়াস ছিলো না। বাধাহীনভাবে বর্বরতা চালায় হানাদার বাহিনী।
প্রায় একই রকমের বর্বরতার মধ্যদিয়ে বড়বড় শহরগুলো দখল করে নেয় দখলদার বাহিনী। কিন্তু পুরো একমাস বরিশাল ছিলো মুক্তাঞ্চল। এদিকে পাকিস্তান বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পনের এক সপ্তাহ আগে, ৮ ডিসেম্বর বরিশাল শহরে বীরদর্পে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনী। বিনা বাঁধায় দখল করে নেয় কোতয়ালী থানাসহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। একই সময় বরিশাল থেকে অবনত মস্তকে ঢাকার দিকে পালাতে থাকে দখলদার বাহিনী। পাকিস্তানী ‘মরু সিংহরা’ আটমাসের মধ্যেই বরিশালের হয়ে যায় মেশ শাবক!
বরিশালের এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আরো একটি বিশেষ ঘটনা হচ্ছে, যারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বরিশাল অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন তারা ভারত যাননি। আর যারা ভারতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একমাত্র তরুণ দেব বরিশাল ফিরেছেন যুদ্ধ চলাকালে, নভেম্বর মাসে। বাকীরা বরিশাল ফেরেন যুদ্ধ শেষে দেশ হানাদার মুক্ত হবার পর। তাঁরা আসলে বরিশালের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণপন লড়াই দেখেননি। এদিকে ভারতে থাকাকালে এদের অনেকের বিষয়েই নানান ধরনের কেচ্ছা-কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।
আরো আছে। ভারত ফেরত বহরের সঙ্গে মিশে গিয়ে বরিশালে অনেকেই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হয়েগেছেন! যাদের অনেকেরই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিলো না। কেউ আবার শুরুর দিকে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হলেও নানান বৈরিতায় মাসখানেকের মধ্যেই ফিরে এসেছেন। এদের মধ্যে কেউ পিতার কানেকশনে মুচলেকা দিয়ে দারমুক্ত হয়েছেন। কেউ আবার আত্মগোপন করে থেকেছেন বোনের বাড়িতে। এ সময় আশেপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতার সময়ও মুক্তিযুদ্ধ মুখি হননি। ঘর থেকে উঠানেও নামেননি বলে রটনা আছে। আর ঘটনা হচ্ছে, এ সময় বোনের ননদ অর্থাৎ বেআইনের সঙ্গে প্রেম করে সময় কাটিয়েছেন। এরপরও হয়েগেছেন মুক্তিযোদ্ধা। এই সূত্রে তিনি মুক্তিযোদ্ধা নেতাও। এদের গ্রুপটিই ‘সিক্সিসটিন ডিভিশন’ হিসব পরিচিত।  এদের সংখ্যা অনেক। কারাকারো মতে ‘সিক্সিসটিন ডিভিশন’-এর সদস্য সংখ্যা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়।

বরিশালে আর একদল মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। যারা ছিলেন রাজাকার এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পরিবারের সন্তান। এমন কি অস্ত্রধারী লুটেরা রাজাকাররাও মুক্তিযোদ্ধার পালক ধারণ করেছেন। এই ‘সুযোগ’ এসেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘৃন্যতম নিষ্ঠুরতার পর জেনারেলর জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার কিছু দিনের মধ্যেই।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বরিশালে রটিয়ে দেয়া হয়েছিলো, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাদের ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হবে।

উদ্দেশ্য প্রনোদিত এ রটনার ফলে একদল মুক্তিযোদ্ধা নিজদেরকে গুটিয়ে ফেলেন। কেউ চলে যান বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠনের আশ্রয়ে। কেউ পালান এলাকা ছেড়ে। এ ঘটনা ‘সিক্সিসটিন ডিভিশনের’ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ক্ষেত্র প্রস্তুত করেদেয়। পাশাপাশি রাজনীতিতে নতুন ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েযায় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি কেন্দ্রগুলো।

# আগামী কাল দ্বিতীয় পর্ব ‘পুলিশ লাইন্স থেকে আনা হয় অস্ত্র’