১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যালীলায় সপরিবারে নিহত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই কালরাতে আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতেও চলে নৃশংস হত্যাকান্ড। সেদিন ঘাতকদের বুলেটের নিশানা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে যান ঘটনাচক্রে বিদেশে থাকার কারণে। শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনা ও ভগ্নিপতি ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে জার্মানিতে গিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ৩১ জুলাই।
শেখ রেহানার দেশে ফেরার কথা ছিল ২২-২৩ আগস্ট। কিন্তু তিনি দেশে ফিরলেন প্রায় আট বছর পর ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে তিনি হারিয়েছেন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মা-বাবা-ভাই-ভাবীদের। বিদেশে না গেলে তাকেও হয়তো একই পরিণতি বরণ করতে হতো। তিনি ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন। অবশ্য এ বাঁচাকে বাঁচা বলে মনে করেন না শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার সাক্ষাৎকার গ্রহণকরি ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ। যা সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে প্রকাশিত হয় ১৬ মার্চ। দেড় বছর বয়সী একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার পক্ষ থেকে ১৯৮৭ সালে শেখ রেহানার সাক্ষাৎকার নেওয়া খুব একটা সহজ কাজ ছিল নাÑ এমনই বিবেচনা আমার ছিল তখনও। অনিশ্চয়তাও ছিলো। তবে শেষতক ব্যর্থ হইনি। আর এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে আমার দক্ষতার পরিবর্তে ভাগ্য ও শেখ রেহানার উদারতা বেশি কাজ করেছে বলে ধারণা। আর পেশাগত জীবনে অন্যতম একটি দিক যোগ হয়েছে শিশুকালে টিউলিপকে কাছ থেকে দেখা।
‘কখনো রাজনীতি করব না: শেখ রেহানা’- এ শিরোনামে শেখ রেহানার সাক্ষাৎকারভিত্তিক আমার প্রচ্ছদ রিপোর্ট সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ-এ ছাপা হয়েছিল ১৯৮৭ সালের ১৬ মার্চ। সাক্ষাৎকারের জন্য আমি শেখ রেহানাকে ফোন করি ১ মার্চ (১৯৮৭)। সরাসরি তিনি ফোন ধরেছেন। প্রথমে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। তবে কোনরকম অবজ্ঞাও করেননি। অথবা খটকরে টেলিফোনও রেখে দেননি। সে সময় আমার মূর্খ সাহস অথবা শেখ রেহানার নরম মানসিকতা, যে কারণেই হোক আমি তাঁকে নাছোড়বান্দার মতো অনুরোধ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। রিপোর্টারের কৌশল হিসেবে প্রকারান্তরে এও ধারণা দিলাম, তাঁর সাক্ষাৎকার দেওয়া না দেওয়ার ওপর আমার চাকরি থাকা-নাথাকা অনেকখানি নির্ভর করে। সম্ভবত একজন অতি সাধারণ সাংবাদিকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়েই তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছিলেন। তবে স্পষ্ট শর্ত দিলেন, কোনো রা-জ-নৈ-তি-ক প্রশ্ন করা যাবে না। আমি তাতেই রাজি হয়েছিলাম মুখে, অন্তরে ছিলো অন্য। শেখ রেহানার কাছ পর্যন্ত পৌঁছানো ছিল আমার লক্ষ্য। যা তখনকার বাস্তবতায় মোটেই সহজসাধ্য ছিলো না।
শেখ রেহানার মুখোমুখি হওয়ার পর্বটি সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ থেকেই উদ্ধৃত করি, “পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুসারে তাঁর বাসায় যাই ৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায়। দোতলায় উঠে দরজার বেল বাজাবার পর একজন এসে আমাদের পরিচয় জেনে ভিতরে গেল। এ সময় চার-পাঁচ বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে এসে দাঁড়ালো নেটঘেরা দরজার ওপারে। ক্যামেরা দেখে বলল, ও আপনারা ছবি তুলবেন। ক্যামেরাম্যান ছিলেন ফরিদ বাশার। শিশুটির আগ্রহ ফরিদের গলায় ঝুলানো ক্যামোর দিকে।
মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম, তোমার নাম কি?
: টিউলিপ।
: কী?
: টিউলিপ, টিউলিপ!
যে টিউলিপ ’৮৭ সালে সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ-এর ক্যামেরা দেখে আকৃষ্ট হয়েছিল সেই টিউলিপ সিদ্দিক ২০১৫ সালে বিশ্বব্যক্তিত্ব হিসেবে আকৃষ্ট করেছে আন্তর্জাতিক শত ক্যামেরা। যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে চমক দেখিয়ে প্রথমবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েই এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ৩২ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিক। যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি, শেখ রেহানার মেয়ে। বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচিত নাম টিউলিপ। এর মধ্যে তাঁর খালা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করছেন চার মেয়াদে। এর মধ্যে এখন চলছে একটানা তৃতীয় মেয়াদ।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি, শেখ রেহানার মেয়ে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নিÑ এ ধারাবাহিকতায় কতভাবেই টিউলিপকে চিনতে পারত দেশের মানুষ। যেমনটি হয় আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এ ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে টিউলিপ সিদ্দিক এখন বিশ্বনন্দিত নাম। এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক পরিবারের।
আমরা শেখ রেহানার ফ্লাটের দরজায় দাঁড়িয়ে টিউলিপের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই এলো তাঁর বড় ভাই ববি। টিউলিপের চেয়ে বছর দু’একের বড় সম্ভবত। ববি নেটের দরজা খুলে দিল। এর মধ্যে শেখ রেহানা এলেন। প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যার মুখোমুখি হলাম। এর আগে-পরে পেশাগত কারণে বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যার মুখোমুখি হয়েছি একাধিকবার।
(আগামী কাল দ্বিতীয় র্পব: “কোনো রা-জ-নৈ-তি-ক
কথা হবে না” )