Home বরিশাল অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হালিমা খাতুন স্কুল, পরিস্থিতি সামলাতে আসতে হয় যৌথবাহিনী

অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হালিমা খাতুন স্কুল, পরিস্থিতি সামলাতে আসতে হয় যৌথবাহিনী

মশিউর রহমান তাসনিম:
অনিয়ম ও দুর্নীতিতে চরম সংকটে পড়েছে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী হালিমা খাতুন স্কুল। শিক্ষকরা নিয়োজিত কোচিং বানিজ্যে ‍এবং প্রধান শিক্ষক মাতোয়ারা লাগামহীন দুর্নীতিতে। স্কুলের লেখা-পড়ার মান তলানীতে পৌছেছে। স্কুলটিতে অবৈধভাবে ও জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ, কোচিং বানিজ্যের টাকার ভাগ- বাটোয়ারা, কোন্দল ও অনিয়মের কারনে স্কুলটির সুনাম আজ তলানীতে বলে জানিয়েছেন স্কুলটির সচেতন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।

আরো পড়ুন……….

অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হালিমা খাতুন স্কুল, ১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ

সবমিলিয়ে বহু আগেই স্কুলটি ডুবকে বসেছে। ‍এদিকে‍ ১৭ নভেম্বর পরিস্থিতির ‍এতোটাই অবনতি ঘটে যে পরিস্থিতি সামলাতে যৌথবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। বিভিন্ন ‍উৎসের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্ধ ও কোন্দল চরমে পৌছেছে। কোনকোন ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের শিক্ষকদের দমন করা হচ্ছে স্পর্শকাতর বিষয়ে অভিযোগ আনা হচ্ছে। এমনকি ১৩ ছাত্রীকে যৌন হেনস্থা করার চেষ্টা করার অভিযোগ এনে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক মাইদুল ‍ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে মাস কয়েক আগে। ‍এ নিয়ে আদলতে মামলা চলছে। ‍এই মামলার প্রধান স্বাক্ষী ‍ইংরেজির সিনিয়র শিক্ষক মো: মহিউদ্দিনের ‍উপর হেডম‍াস্টার ‍এস ‍এম ফখরুজ্জামানের ভারাটে মাস্তানদের হামলার ঘটনায় ১৭ নভেম্বর পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। যৌথবাহিনীকে হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে চাপা ‍উত্তেজনা আব্যাহত রয়েছে। সংশ্লিষ্টা বলছেন, হেডম‍াস্টার ‍এস ‍এম ফখরুজ্জামানকে অপনসারণ ছাড়া পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।

হেডম‍াস্টার ‍এস ‍এম ফখরুজ্জামানের অনিয়মের বিরুদ্ধে মানববন্ধন

হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগে জালিয়াতি, ভুয়া সনদ দিয়ে শিক্ষকতা, বিভিন্ন আসবাবপত্র ক্রয়ের নামে ভুয়া বিল ভাউচারসহ শত অভিযোগ বলে জানিয়েছেন স্কুল সংশ্লিষ্টরা। জেলা শিক্ষা অফিস ও বিভাগীয় অফিসে আবেদন করেও কোন সাড়া পাচ্ছেনা অভিযোগকারীরা। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ‍এস ‍এম ফকরুজ্জামান। তিনি সাবেক সচিব ও পিএসসির অপসনারিত সদস্যের আত্মীয় হিসেবে প্রভাবশালী বিস্তার করতের বলে জানাগেছে।
হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ে চলছে লুটপাট- এমন অভিযোগ সংশিষ্টদের। এছাড়া শ্রেনী কক্ষ ভেঙ্গে করা হয় প্রধান শিক্ষকের বাস ভবন। অভিযোগ আছে, স্কুলের আয়ের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেন করেন ‍একটি চক্র। অথচ নানান বিষয়ে সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেই। কোনবিধি বিধান না মেনেই সম্প্রতি একজন শিক্ষিকাকে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়ে নানান কথা চলছে স্কুল জুড়ে।
চলতি বছরের পহেলা বৈশাখ ছিল ঈদুল ফিতরের তৃতীয় দিন। রমজান, ঈদ ও নববর্ষ মিলিয়ে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন ছিল দীর্ঘ ছুটি। তবে পহেলা বৈশাখে বরিশাল নগরের হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘অভিভাবক সমাবেশের’ জন্য ২৮ হাজার টাকার বিরিয়ানি কেনেন প্রধান শিক্ষক এস এম ফখরুজ্জামান! তিন দিন পর ১৭ এপ্রিল একই কারণে দেখানো হয় ২০ হাজার টাকার বিরিয়ানির ভাউচার। তবে সব আয়োজনই ছিল কাগুজে। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের চলমান তদন্তে এমন গায়েবি অনুষ্ঠান ও কেনাকাটার তথ্য মিলেছে। শুধু বিরিয়ানি নয়, ভৌতিক কেনাকাটার ভাউচার দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জেরার মুখে হেডম‍াস্টার ‍এস ‍এম ফখরুজ্জামান। ছবি: দখিনের সময়

নগরীর গোঁড়াচাঁদ দাস সড়কের হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় বরিশালের সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। তিন সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর এ বিদ্যালয়ে বার্ষিক আয় প্রায় ৩ কোটি টাকা। গত কয়েক বছরে কোচিং বাণিজ্য নিয়ে শিক্ষকদের দলাদলি, এর জেরে ছাত্রীদের দিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটি আলোচিত-সমালোচিত। অভিযোগ, এসবের হোতা প্রধান শিক্ষক এস এম ফখরুজ্জামান। এ নিয়ে সমকালে একাধিক প্রতিবেদন হয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় প্রধান শিক্ষকের কাছে বিদ্যালয়ের গত ১০ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব চাওয়া হয়। তাঁর দেওয়া ভাউচার অনুযায়ী, সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান গত সপ্তাহে ১২টি দোকানে যান। সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানান, ভাউচারের তারিখে তারা ওই বিদ্যালয়ে কোনো পণ্য বিক্রি করেননি। পূর্ব পরিচয়সূত্রে প্রধান শিক্ষক তাদের কাছ থেকে সাদা ক্যাশমেমো নিয়ে ভুয়া ভাউচার করেছেন।
রোববার(১৭ নভেম্বর) বিদ্যালয় সংলগ্ন চারটি প্রতিষ্ঠানে গিয়েও একই তথ্য পাওয়াগেছে। মুন টেইলার্সের একটি ভাউচারে বিদ্যালয়টির ব্যান্ড বাদক দলের জন্য পোশাক তৈরি ও জুতা ক্রয়ে ৯১ হাজার টাকা ব্যয়ের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক মোস্তফা সরদার জানান, তিনি এমন কোনো পোশাক তৈরি করেননি। আর তাঁর দোকানে জুতা বিক্রি হয় না। প্রধান শিক্ষক সাদা মেমো চেয়ে নিয়েছিলেন।
মুসলিম সুইটসের মালিক রিপন বলেন, পহেলা বৈশাখে বিরিয়ানি বিক্রির একটি ভাউচার নিয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর দোকানে এসেছিলেন। তবে তাঁর দোকান তো মিষ্টির। কোনো দিন বিরিয়ানি বিক্রি করেননি। এমনকি ভাউচারটিতে তাঁর দোকানের নাম থাকলেও এটি তাদের নয়।
নবাব বিরিয়ানি ঘরের মালিক ইমরান হোসেন বলেন, ২০ হাজার টাকার বিরিয়ানির ভাউচারের ক্রমিক নং ২১৩। ওই ক্রমিক নম্বরের ভাউচারটি তিনি ব্যবহার করেছেন ৯ সেপ্টেম্বর। তিনি বিষয়টি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান বলেন, ১০ বছরের হিসাব চেয়েছিলাম। এক বছরের হিসাব মেলাতেই হিমশিম খাচ্ছি। বিদ্যালয় পুকুরের চারপাশে ওয়াকওয়ে ও উদ্যান নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু বিধি না মেনে কাজটি করা হয়েছে দরপত্র আহ্বান ছাড়া। এদিকে তদন্ত কর্মকর্তারা গতকাল ফের বিদ্যালয়টিতে যান। সেখানে ক্রয় কমিটির চার শিক্ষকের মধ্যে তিনজন লিখিতভাবে তাদের জানান, সব ভাউচার যাচাই-বাছাই করে সই করার সুযোগ তাদের হয়নি। কমিটির সদস্য সহকারী শিক্ষক শফিকুল ইসলাম এ তথ্য সমকালকে নিশ্চিত করেছেন।
বিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও পিএসসি সদস্য ফয়েজ আহমেদ প্রধান শিক্ষকের ভগ্নিপতি। এ জন্য তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। এখন মহানগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নতুন করে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।  এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক ফখরুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তদন্তাধীন বিষয়ে কথা বলবেন না বলে জানান।
শিক্ষককে মারধরের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মানববন্ধন বিদ্যালয়ে ঢুকে এক শিক্ষককে বহিরাগতদের মারধরের প্রতিবাদে প্রধান শিক্ষকের বিচার চেয়ে রোববার(১৭ নভেম্বর) স্কুল সংলগ্ন সড়কে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার(১৪ নভেম্বর) দুপুরে  প্রধান শিক্ষক ফখরুজ্জামানের পক্ষে একদল বহিরাগত যুবক বিদ্যালয়ে ঢুকে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. মহিউদ্দিনকে মারধর করে।
সেখান থেকে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক তারেক সোলায়মানকে বিক্ষুব্ধরা আটক করেন। পরে সেনাবাহিনীর কাছে মুচলেকা দিয়ে তিনি ছাড়া পান। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক দাবি করেন, বরখাস্ত শিক্ষক মহিউদ্দিনকে বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ে ঢুকে উস্কানিমূলক লিফলেট বিতরণ করায় অভিভাবকরা মারধর করেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হালিমা খাতুন স্কুল, পরিস্থিতি সামলাতে আসতে হয় যৌথবাহিনী

মশিউর রহমান তাসনিম: অনিয়ম ও দুর্নীতিতে চরম সংকটে পড়েছে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী হালিমা খাতুন স্কুল। শিক্ষকরা নিয়োজিত কোচিং বানিজ্যে ‍এবং প্রধান শিক্ষক মাতোয়ারা লাগামহীন দুর্নীতিতে। স্কুলের...

শীত নিয়ে নতুন বার্তা আবহাওয়া অফিসের

দখিনের সময় ডেস্ক: সারা দেশে শীতের অনুভূতি বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বর্তমানে দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করছে চুয়াডাঙ্গায় ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সোমবার (১৮...

অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদ চার বছরের কম হওয়া উচিত: ড. ইউনূসের

দখিনের সময় ডেস্ক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদ চার বছরের কম হওয়া উচিত, তা নিশ্চিত। এটা আরও কম হতে পারে। এটা পুরোটা নির্ভর...

খোলামেলা পোশাকে নজর কাড়ার চেষ্টা ভাবনার

দখিনের সময় ডেস্ক: খোলামেলা পোশাকে ভক্তদের হৃদয়ে ঝড় তুলতে জুড়ি নেই অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়সই উত্তাপ ছড়ান তিনি। নিজের সাহসি অবতারের...

Recent Comments