• ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ যন্ত্রণা, কৃষক ফিরছেন গরু-লাঙ্গল

দখিনের সময়
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৯, ২০২৫, ০৮:১৪ পূর্বাহ্ণ
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ যন্ত্রণা, কৃষক ফিরছেন গরু-লাঙ্গল

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যন্ত্রণায় পৃষ্ঠ প্রান্তিক কৃষকরা আবার সনাতনী গরু-লাঙ্গল মুখি হচ্ছেন। ছবিটি বরিশাল সদর উপজেলার ১নং রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নের ধর্মাদী গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: দৈনিক দখিনের সময়

সংবাদটি শেয়ার করুন...
আলম রায়হান:
বাংলাদেশের কৃষি খাতে ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণের গাল-গপ্প তুঙ্গে উঠেছিলো। কিন্তু এই ধারা যত না উচ্ছ্বাসের তার চেয়ে অনেক হতাশা বয়ে এনেছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কৃত্রিম জোয়ারে জমি চাষে প্রান্তিক কৃষকরা একদিকে নিজস্ব সক্ষমতা হারিয়েছে, অন্যদিকে সরকারী প্রনোদনার আওতায় কৃষকদেরকে যেসব কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে তা এক বছরের মধ্যে বিকল হতে শুরু করেছে। এবং তিন থেকে চার বছরের মধ্যে অচল হয়েগেছে। এগুলো চলে গেছে ভাঙ্গারীর দোকানে। এই সুযোগে জমিচাষ ও সেচ ব্যবস্থা পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এর বহু আগে ‘বীজ বানিজ্য’ দ্রুত চলেগেছে বহুজাতিক কোম্পানীর দখলে। দেশী-বিদেশী মিলিয়ে বীজ চক্র এতই শক্তিশালী যে, সরকারী সংস্থা বিএডিসি’র নাভিশ্বাস উঠেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানাগেছে।
এক সময় প্রচারণার তুঙ্গে ছিলো, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। যার মূলে আছে বিকল্প উপকরণ, শ্রমের স্বল্পতা এবং মজুরির ঊর্ধ্বগামী প্রবণতা। কিন্তু কৃষকের সামনে যান্ত্রিকীকরণ একটা প্যারাডক্স জন্ম দিয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ যদি কৃষকের জন্য ফলন এবং লাভ উভয়ই বাড়িয়ে দিত তাহলে কৃষককে যন্ত্রণায় ভুগতে হতো না। অভিযোগ আছে, কৃষকরা নিম্নমুখী মার্জিন নিয়ে মাঝেমধ্যে মহাবিপদে পড়েন। গবেষকরা যুক্তি দেখিয়েছেন, সবচেয়ে শ্রমঘন হলো রোপণ ও মাড়াই। যেখানে সাধারণ যন্ত্রের উপস্থিতি নেই। এবং এক্ষেত্রে শ্রমের উচ্চ মজুরির কারণে কৃষকের মুনাফা হ্রাস পায়।
‘কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণই পারে কৃষকের যন্ত্রণা লাঘব করতে’- এ উচ্ছ্বাস আছে অপেক্ষাকৃত কম শ্রমঘন চাষাবাদ ও ফসল মাড়াইয়ে যন্ত্রের ব্যবহার দেখে। কিন্তু উদীয়মান উদ্বেগ শ্রমনিবিড় রোপণ ও ফসল মাড়াইয়ের মাঠে যন্ত্রের খুব কম উপস্থিতির কারণে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে শেষোক্ত যন্ত্রগুলো বিশাল এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাছাড়া সেচ-যন্ত্রের মতো বহুবিধ ব্যবহারের অনুপস্থিতি অর্থনৈতিক লাভালাভকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের কৃষি এখনও প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের হাতে, যাদের পক্ষে এরকম শ্বেতহস্তি পোষা প্রায় অসম্ভব।
কৃষি কাজে খরচ কমাতে আধুনিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে একলাপে তালগাছের মাথায় উঠতে হবে! আমাদের যেটা করা হয়েছে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে। যার কুফল এরই মধ্যে প্রন্তিক কৃষিতে প্রকট হয়ে উঠেছে। আসলে প্রয়োজন হচ্ছে বিদ্যুৎ অথবা জালানী ছাড়া ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন ধরনের কৃষি সহায়ক যন্ত্রপাতি। এবং কৃষকদেরকে সাহস যেগোনো। আশার কথা হচ্ছে, কৃষি সহায়ক যন্ত্রপাতি এরই মধ্যে প্রাইভেট খাতে উৎপাদিত ও বাজারজাত করা হচ্ছে। এগুলোও সার-বীজের মতো সরকারী প্রনোদনার আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করা হয়।
ফিরে আসছে
গরু-লাঙ্গল
যান্ত্রিকীকরণের কৃত্রিম জোরায়ে কৃষকরা নিজেদের হাল-গরু হারিয়ে ফেলেছিলো। এদিকে সরকারের প্রনোদনার পাওয়ার টিলার তিন-চার বছরের মধ্যেই চলেগেছে ভাঙ্গারীর দোকানে। ফলে প্রান্তি চাষিরা বিপাকে পড়েন জমি চাষ দেয়া নিয়ে। সবারই জানা, যে ফসলই চাষ করা হোক না কেন, প্রথমেই ঘটে জমি চাষ করার বিপত্তি। কারণ সরকারী প্রচারনা এবং প্রনোদনায় পাওয়ার টিলারের অনুপ্রবেশের ফলে দ্রুত বিলুপ্ত হয়েগেছে গরু-লাঙ্গল। এখন কোন গ্রামেই দুই একটির বেশি পাওয়ার টিলারের অস্তিত্ব নেই। তারও আবার রাজধানীর লক্করঝক্কর বাসের মতো। এগুলো ব্যক্তি মালিকানার। ফলে ফসল ফলানোর প্রথম ধাপ জমিচাষ করতেই কৃষকতে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। যা বহন করা অনেক কৃষকের জন্যই কষ্টসাধ্য। ফলে অনেক কৃষক কোদাল নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কোদাল দিয়ে জমি প্রস্তুত করা খুবই কষ্ট সাধ্য। এই বাস্তবতায় কোনকোন এলাকায় গরু-লাঙ্গল ফিরে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু নানান কারণে গরু-লাঙ্গল ফিরে আসার ধারা মোটেই সহজ নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে অসাধ্য হয়ে দাড়িয়েছে।
প্রথমত, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ‘গীতে’ আচ্ছ সরকারের তরফ থেকে গরু-লাঙ্গল এর জন্য কোন রকম প্রনোদনা আছে বলে জানাযায়নি। এদিকে ব্যক্তি উদ্যোগে কৃষক পর্যায়ে গরু-লাঙ্গল ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন। অরো সমস্যা আছে। গো-খাদ্যও চলেগেছে বহুজাতিক কোমাম্পানীর নিয়ন্ত্রণে। এর দাম অনেক চড়া। এদিকে বালাইনশাক নামের বিষে প্রাকৃতিক ঘাস এতোই বিষাক্ত হয়ে পড়েছে যে তা খেলে গরু অসুস্থ হয়ে পড়ে। মৃত্যুও ঘটে। এ অবস্থায় প্রান্তি পর্যায়ে চাষীদের জন্য প্রয়োজন সনাতনী কৃষিযন্ত্রপাতি আধুনিকরণ। পাশাপাশি প্রয়োজন হালে গরু খাতে সরকারের প্রনোদনা, পাওয়ার টিলার নয়। আর প্রয়োজন, কৃষিতে বালাই নাশক নামের বিষ প্রয়োগের লাগাম শক্তভাবে টেনে ধরা।