Home মতামত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত' একাত্তরের ১১ এপ্রিল প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রথম...

‘স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত’ একাত্তরের ১১ এপ্রিল প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভাষণ: জাফর ওয়াজেদ

জাফর ওয়াজেদ:
বায়ান্ন বছর আগে একাত্তরের ১১ এপ্রিল ছিল গণহত্যা, ধংসযজ্ঞ, পাশবিকতা, লুট, ধর্ষণ, যুদ্ধ আর নারকীয়তার বিপরীতে বাঙালি জাতির জাগরণের, উত্তরণের, প্রতিরোধের, প্রতিশোধের, শত্রু হননের এক রক্ত-বারুদে মাখা দিন। দখলদার পাক হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে একদিন আগে দশ এপ্রিল বাঙালি বংশোদ্ভূত পাকিস্তানীবাদী সমন্বয়ে ‘শান্তি কমিটি’ নামক গেস্টাপো বাহিনী গঠন করে এবং দেশব্যাপী তাদের সহায়তায় ধর পাকড়, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ড সংঘটনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর এই দশ এপ্রিল কুষ্টিয়া সীমান্তে গঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং তার প্রথম সরকার। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী এমএনএ ও এমপিএদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে। এই বৈঠকে রাষ্ট্র ও সরকার গঠন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করা হয়। বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং এর নেতৃত্বে নয়া রাষ্ট্রকে শত্রæমুক্ত করতে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংবাদ প্রচারিত হয়। বিশ্ববাসী সেদিন জেনে যায়, ‘যুদ্ধ ক্ষেত্রাস্তীর্ণ ধংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালি জাতি জন্ম নিলো।’ আর এর একদিন পর ১১ এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণ দিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই ভাষণটি আকাশবাণী প্রচার করেছিল, স্বাধীন বাংলা বেতারের বরাত দিয়ে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ভাষণের অনুলিপি সাংবাদিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। আর এই ১১ এপ্রিল ঢাকায় দখলদার পাকবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার পদে দায়িত্ব নেয় খুনী জেনারেল নিয়াজী। আর ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকবাহিনী তার নেতৃত্বে।
বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত সে দিন জেনেছিল বাংলাদেশ নামক এক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের কথা। বিশ শতকে ঘোষণা দিয়ে স্বাধীন হওয়া দেশটিতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমর্থনে সরকার গঠিত হয়। যে সরকারের রাষ্ট্রপতি হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি তার দেশবাসীকে হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহŸান জানিয়ে গ্রেফতারের আগে স্বাধীনতার ঘোষণা জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং অপর ৩ জনকে মন্ত্রী করে গঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ১০ এপ্রিল গঠিত এই সরকার ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিক শপথ নেয় বলে এই সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিতি পায়।
একাত্তরের ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় রামগড় সীমান্তে অবস্থিত এবং শর্টওয়েভে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (২য় পর্যায়) থেকে প্রচারিত পূর্ব রেকর্ড করা ভাষণটি ছিল বাংলায়। প্রথম সরকারের প্রথম কেবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম সেদিনের ভাষণের উল্লেখ করে লিখেছেন, “প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মুক্তি পাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে সকলকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে কেন দেশকে শত্রæমুক্ত করার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো তার আনুপূর্ব বর্ণনা দেন। কোন্ কোন্ সেক্টরে কার অধীনে যুদ্ধ চলছে তার বিবরণও তুলে ধরেন তিনি। তাঁর সুদীর্ঘ ভাষণে বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি দস্যুদের গণহত্যার উল্লেখ করে তিনি পৃথিবীর সকল দেশের নিকট থেকে অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান। যুদ্ধের সময় শত্রুকে সহযোগিতা না করার আহŸান জানিয়ে সম্মিলিত মনোবল ও অসীম শক্তি নিয়ে দেশবাসীকে যুদ্ধে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিতে নির্দেশ দেন।” এই ভাষণে বাঙালি জাতির প্রথম সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার পথ ও প্রক্রিয়া নির্দেশিত ছিল। বায়ান্ন বছর আগে এক রক্তাক্ত বধ্যভূমিতে পাক হানাদারদের গুলিতে শহীদ হবার আগে যে যুবকটি শেষ আর্তনাদ উচ্চারণ করেছিল “জয় বাংলা”- সেই রণধ্বনিকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ তার ভাষণের মধ্য দিয়ে।
সে এক সময় ছিল। জীবন মরণ আশা-নিরাশার দোলাচলে এক কঠিন কঠোর ক্রান্তিকালের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সাড়ে সাতকোটি মানুষ। বায়ান্ন বছর আগে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি তার সহস্র বছরের ঘুম শেষে সটান জেগে ওঠেছিল। প্রবল প্রতাপে রক্ত আর জীবনদান করার সেই এক কালজয়ী, দুঃখজয়ী সময় এসেছিল ৫৫ হাজার বর্গমাইলের বদ্বীপ অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনে। তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল অসম এক যুদ্ধ। অদম্য সাহস আর মনোবল নিয়ে সাড়ে সাতকোটি মানুষ সেদিন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। আর এর মধ্য দিয়ে গঠিত হয় এই প্রথম বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র, স্বাধীন দেশ।
একাত্তরে নতুন এক বাঙালি জাতি জন্ম নেয়। আর এ জন্ম এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমেই ঘটে। বিশ শতকে বাঙালিই একমাত্র জাতি যে ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে বাংলার জনগণ বিপুল ভোটে ৬ দফার পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে। বাংলায় প্রতিদ্ব›দ্বী দল জামায়াতে ইসলামী ২টি আসন ছাড়া ও মুসলীম লীগের সমস্ত প্রার্থীর পরাজয় ঘটে। ৯০ ভাগ জামানত হারায়। নির্বাচনের পর শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে শুরু হয় পাকিস্তানী সামরিক চক্র ও তাদের দোসরদের নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে তা স্থগিত করায় একাত্তরের মার্চের ১ তারিখেই বাঙালি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঢেউ জাগে। বাঙালি জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। আর সেই ১ মার্চ থেকে বাংলাদেশ কার্যত পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন সত্তার আকার ধারণ করে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দিকনির্দেশনাপূর্ণ ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। বাঙালি জাতি কঠিন সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে শুরু করে ৭ মার্চ থেকে। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হবার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ও দেশকে শত্রæমুক্ত করার আহŸান জানান। তার এই নির্দেশ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানীরা তথাকথিত সামরিক আদালতে বিচারের নামে প্রহসন করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম ভাষণে জাতিকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, “আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস; কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতির পাচ্ছে।” বাংলাদেশে গণহত্যা ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার নিন্দায় তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন। দূরদর্শী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে স্থির বিশ্বাসের পাশাপাশি আশংকাও করেছিলেন, যা বাস্তব হয়েছিল। বলেছিলেন, “আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেওয়ার আগেই শত্রæরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধংসলীলা সৃষ্টি করবে।” সেজন্য এপ্রিলের ১১ তারিখে জনগণকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে বলেছিলেন, ‘পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।”
তাজউদ্দীন আহমদ ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক পাকবাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর তিনি সীমান্ত পাড়ি দেন। একাত্তরের ১ এপ্রিল গভীর রাতে তিনি নয়াদিল্লী পৌঁছেন। ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এবং পরে ইন্দিরার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কাছে অস্ত্রসহ সাহায্য কামনা করেন। সেই সঙ্গে পাকবাহিনীর নির্যাতনে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, আশ্রয় সহায়তাও চেয়েছেন। বৈঠকে তাজউদ্দীন উপলব্ধি করেন দ্রæত সরকার গঠন করা হলে সরকারীভাবেই সাহায্য সহায়তা মিলবে ভারতসহ বিশ্ববাসীর কাছ থেকে। ৫ এপ্রিল দিল্লীতে বসে প্রফেসর রেহমান সোবহান ও ব্যারিষ্টার আমীরুল ইসলামের সহায়তায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক বিবৃতি ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করেন। এর বাংলা ও ইংরেজি ‘ভার্সন’ তৈরির কাজটিও একই সঙ্গে করা হয়। ৮ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে সরকার গঠন সম্পর্কিত তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি রেকর্ড করা হয়। যা আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১০ এপ্রিল প্রচার করা হয়। সে সুবাদে বিশ্বের অন্যান্য গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। সরকার গঠনের ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিনের ভাষণটি ঐদিনই রেকর্ড করা হয়। যা ১১ এপ্রিল প্রচারিত হয়।
বায়ান্ন বছর আগে প্রচারিত স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, গুরুত্বপূর্ণ এই ভাষণ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশ্লেষিত হয়ে জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়নি বলে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আজো তৈরি করা হচ্ছে। যা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের গঠন ও তার সনদপত্র এবং সংবিধানকে অবমাননা শুধু নয়, একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধকে হেয় প্রতিপন্ন করে স্বাধীনতার শত্রæদের মনোবাঞ্ছাকে সামনে আনা। তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিলের ভাষণেই বলেছেন, “২৫ শে মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করবার আহŸান জানিয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।” এই ভাষণের আগের দিন গণপরিষদের বৈঠকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অনুসমর্থনদান করেন গণপরিষদের সদস্যরা। সেই ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্র“তি পালনের পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহŸান জানান।”
পরিষদের সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, “আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে।” বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন তাই জেনে এসেছে। কারণ জনগণ দীর্ঘ নয়মাস অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, নিপীড়ণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ গণহত্যার শিকার হয়েছে। আর তা সহ্য করেছে বঙ্গবন্ধুর সেই আহŸানে, যা তিনি ৭ মার্চের পর ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। এবং তা করেন জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচনে বিজয়ী দলের প্রধান এবং যার হাতে দেশের ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা- সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কারণ স্বাধীনতার ঘোষণার বৈধ অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই ছিল। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার যে ঘোষণা পাঠ করেন, তা বঙ্গবন্ধুর নামেই করেছিলেন। আর ২৬ মার্চের ১৫ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণার আনুষ্ঠানিক বৈধতা দিয়েছিলেন গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা। এই বৈধতা কেবল তাদেরই ছিল জনগণের পক্ষ থেকে।
সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে বাংলাদেশের সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে সামিল হতে এবং স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সাড়ে সাতকোটি মানুষের ঐতিহাসিক প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে চিরাচরিত রাজনৈতিক গন্ডির উর্ধে রাখবার জন্য আহŸান ও আবেদন দুটোই জানান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। তবে তিনি সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত এবং গণহত্যার পর পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশকারীদের তার ভাষণে সতর্ক করে দেন, “হানাদার শত্রæবাহিনীর সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা করা বা সংশ্রব রাখা চলবে না। বাংলাদেশে আজ কোনো মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রæসৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গোর থেকে গাত্রোত্থান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা যদি এই সুযোগে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তারা সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশবাসীর রোষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে।”
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আহŸানে সেদিন পাকিস্তানভিত্তিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভাসানী ন্যাপ একাংশ, ওয়ালী ন্যাপ (মোজাফফর), কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলা কংগ্রেস সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে এসেছিলো। বাঙালির জনগণের সরকারের আহŸানে সাড়া না দিয়ে পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে বাঙালি নিধন, লুন্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগে মত্ত হয়েছিল গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামাতে ইসলামী, খাজা খয়েরউদ্দিনের কাউন্সিল মুসলীম লীগ, সবুর খানের কনভেনশন মুসলীম লীগ, ফজলুল কাদের চৌধুরীর আইয়ুব পন্থী মুসলীম লীগ, মৌলবী ফরিদ আহমদের নেজামে ইসলামী, হাফেজী হুজুরের খেলাফত-ই-মজলিস, নুরুল আমিনের (সত্তরে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য) পিডিপি, আতাউর রহমান খানের বাংলা জাতীয় লীগ এবং জমিয়তে উলামা ইসলাম দল। তারা বাংলাদেশ সরকারের আহŸানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশকে শত্রæমুক্ত তথা পাকহানাদার মুক্ত করে স্বাধীনসত্তা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেনি। বরং তারা পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে সশস্ত্র সংগঠন ‘শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আল বদর, আল শামস বাহিনী গঠন করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের বিরুদ্ধে পাকবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র অভিযানে নামে। তারা পাকবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী বাঙালিদের ঘরবাড়ী চিনিয়ে দেয়ার কাজ শুধুই করেনি, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ নিজেরাও চালিয়েছে।
এই দলগুলো ঘাতক দলে পরিণত হয়। তাদের কর্মীরা হয়ে ওঠে জল্লাদ, কসাই। এমনকি পাকবাহিনীর লালসার সামগ্রী হিসেবে বাঙালি নারীদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে পাক বাহিনীকে ‘উপঢৌকন’ দিয়েছে। চট্টগ্রামে ফজলুল কাদের চৌধুরীর পক্ষ থেকে বাঙালি মহিলাদের আটক করে পাক বাহিনীর জন্য তাদের ভাষায় ‘হেরেমখানা’ চালু করেছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহপাঠিনীকে ধরে নিয়ে সেই ‘হেরেমখানায়’ রাখার খবর মিলেছিল। কিন্তু তাদের কোন খোঁজ আর কখনো মেলেনি। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দেয়নি সেই উনসত্তর সাল থেকে শ্রেণীশত্রæ নিধনের নামে বাঙালি জনগণকে হত্যায় অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা মাওবাদী ও নকশালপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন ও গ্রæপগুলো। এরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং বিজয়ের পরও দলের নামের সঙ্গে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ব্যবহার করে। এরা দেশের বিভিন্নস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে পাকবাহিনীর সহায়তায়। এরা মুক্তিযুদ্ধকে চিহ্নিত করে সেই সময়ে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে। ভাষাসৈনিক নামে অভিহিত আবদুল মতিন এবং আলাউদ্দিনের পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি পাবনা ও যশোরে সেই একাত্তর সালের গোড়ায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত দু’জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে হত্যা করে বলে অভিযোগ ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এরা মুক্তিযোদ্ধা নিধনে মত্ত হয়। চীন যেহেতু পাকিস্তানের সমর্থন করেছে তাই মুক্তিযোদ্ধা নিধন শুধু নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দলের নাম পূর্ব পাকিস্তান বহাল রেখে ভাষা সংগ্রামী আবদুল মতিন শ্রেণীশত্রæ নিধনের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মা-লে) আবদুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা চালায় এবং পাক বাহিনীকে তথ্যাদি সরবরাহ করে। স্বাধীনতার পরও দলের নামে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বহাল রেখে মুক্তিযোদ্ধা নিধনে আবদুল হক অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য চেয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বাঙালি নিধনযজ্ঞের পরিকল্পক জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চিঠি দিয়েছিলেন। যা পরে প্রকাশ হয়।
মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের সাম্যবাদী দল পূর্ব বাংলা নাম ধারণ করে নোয়াখালী রংপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা নিধনসহ পাকিস্তানের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে ‘ভারতীয় চর’ নামে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের আহŸান জানিয়ে লিফলেট প্রচার করেছে। পাকিস্তানী কর্ণেল আশিক হোসেন লরেন্স লিফসুজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার সম্ভাবনা সম্পর্কে তোয়াহা নিজে তার সঙ্গে আলোচনা করে।” সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টিও এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এবং পাক হানাদারদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। চীনাপন্থী আরো কয়েকটি গ্রুপ, উপগ্রুপ ও বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান নেয়। একাত্তরের আগে থেকেই তারা সশস্ত্র ছিল। মুক্তিকামী বাঙালি ও আওয়ামী লীগ ছিল এদের প্রধান শ্ত্রু। এরা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও এরা দেশব্যাপী চোরাগুপ্তা হামলা, মিল-কলকারখানায় অগ্নিসংযোগ, থানা ও ফাঁড়ি লুট, জনপ্রতিনিধি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থিতিশীল করা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আরো বিধ্বস্ত করার পাকিস্তানী নীলনকশা বাস্তবায়নে ‘চীনাপন্থী’ নামধারী দল সংগঠন ও গ্রæপগুলো সক্রিয় ছিল। একাত্তরে এদেশে রাজনীতি চর্চাধারী ইসলামী ও বামপন্থী নামধারী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা শুধু নয়, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে এবং বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল। এই দলগুলো ভেবেছিল যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মুসলিম দেশ ও মার্কিন চীনের সমর্থনে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখবে। তারা ধরে নিয়েছিল আধুনিক সমরসজ্জা এবং কামানের গর্জনের নীচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালির ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা। আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালিকে তারা বুটের নীচে নিক্ষেপ করবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, কারণ ‘একটি ডাকে জেগেছিল সাতকোটি প্রাণ রণাঙ্গণে’ তখন। কে তাদের রুখবে? যারা তাদের নেতা বঙ্গবন্ধুকে প্রতিধ্বনিত করে তখন উচ্চারণ করেছে, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ।’ বাঙালি জাতি তা করেছিল বায়ান্ন বছর আগে।
শুধু রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আহবান জানিয়েছেন তা নয়, প্রধানমন্ত্রী সকল বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান, প্রকৌশলী, সংবাদপত্রসেবী, বেতারশিল্পী, গায়ক, চারুশিল্পীদের অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। ভাষণে তাজউদ্দীন উল্লেখ করেন যে, “শাসনকার্যে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বাঙালি অফিসারদের মধ্যে যারা এখনও আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেন নি, তারা যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা তাদেরকে মুক্ত এলাকায় চলে আসতে আহŸান জানাচ্ছি।… আমাদের সামনে বহুবিধ কাজ; তার জন্যে বহু পারদর্শীর প্রয়োজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ পাবেন।” তবে যাদের পক্ষে নেহাতই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাদেরকে আশ্বাস এবং প্রেরণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী সাড়ে সাতকোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাইবোনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে। হানাদার বাহিনীর বাংলাদেশ দখল করার দু’সপ্তাহের মাথায় মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশ সরকারের আহŸানে সাড়া দিয়েছিলেন কত সংখ্যায়, সেসব আজ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। বায়ান্ন বছর আগের একাত্তরের বাস্তবতায় দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ও তার অংগ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ৮০ শতাংশ এবং নৌকা মার্কায় ভোট দেয়া সাধারণ কৃষক শ্রমিকদের একটি বিরাট অংশ পাকবাহিনীর সঙ্গে লড়াই-এ নেমেছিল। তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণে বলেছেনও, “এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং এর সত্যিকার অর্থে একথাই বলতে হয় যে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র জনতা তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের বিশ্বাস, স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্ন প্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ।”
১১ এপ্রিল একাত্তরের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্বদানকারী সামরিক নেতৃত্বের নামোল্লেখ করে তাদের অসীম সাহসিকতা ও কৃতিত্বের প্রশংসা করেন। মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহর নামোল্লেখ করে বলেছেন, পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক শত্রæনিধনে যৌথ বৈঠক করে পরিকল্পনা নিয়েছেন। তিনি অন্য সেক্টরের সমর পরিচালকদের নামোল্লেখও করেন। প্রধানমন্ত্রী তার দেশকে হানাদার ও শত্রæমুক্ত করার জন্য বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে যেমন, তেমনি প্রবাসী বাঙালিদের কাছে অস্ত্র সাহায্য চান। সেই সঙ্গে বাঙালি নিধনে যাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য বিদেশী রাষ্ট্রকে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য বন্ধের আহŸান জানান।
প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কূটনীতিক ও রাজনীতিক প্রতিনিধিদের তার দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, “তারা যেন স্বচক্ষে এবং সরজমিনে দেখে যান যে, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে।” একটি মুক্তিকামী জাতির মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনাসহ সার্বিক দিক তুলে ধরে যে বক্তব্য দেওয়া সে সময় ছিল সংগত, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সেই অবস্থানকে তুলে ধরেছিলেন। আর তা করেছিলেন বলেই তার বিশ্বাস অনুযায়ী যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল। একাত্তরের ১১ এপ্রিলের ভাষণে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য এবং যোদ্ধাদের সক্রিয় করাসহ বিশ্বজনমত তৈরি ও দেশবাসীকে প্রতিরোধী হবার সমস্ত দিকই প্রতিভাত হয়েছিল। বাঙালির ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল দলিল এই ভাষণ।
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তথা মুজিবনগর সরকার আকারে বিশাল ছিল না। তবে অত্যন্ত সুসংগঠিত ছিল।” বলেছেন সেই সরকারের কেবিনেট সচিব এইচটি ইমাম, “প্রচন্ড প্রতিকূলতার মধ্যে এই সরকার গঠন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একদিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, অন্যদিকে এককোটির উপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা, দেশের অভ্যন্তর থেকে লাখ লাখ মুক্তি পাগল ছাত্র-জনতা যুবাদেরকে যুব শিবিরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা এবং সাথে সাথে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি- এসবই ছিল প্রবাসী সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি। যা সমকালীন ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয়।” ইতিহাস বায়ান্ন বছর পর এই কথাই আজো বলে। আজো স্মরণ করায়, বাঙালি অনেক সাধ্য সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, রক্ত, অশ্রæ, কষ্ট আর দুঃখের ভেতর থেকে তুলে এনেছে তার প্রিয় দেশ, বাংলাদেশ। যে বাংলার জয় সে কামনা করে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের শেষে উচ্চারণ করেন পবিত্র সেই ধ্বনি ‘জয় বাংলা’। মুক্তিকামী বাঙালিরাও সেই ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করে এই বায়ান্ন বছর পরে আজো।
লেখক: একুশে পদপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

বিদেশে চিকিৎসা নিরুৎসাহিত করতে হবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

দখিনের সময় ডেস্ক: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, বিদেশে চিকিৎসা নিরুৎসাহিত করতে হবে। সেজন্য তিনি দেশে চিকিৎসকদের আরো বেশি সেবার মনোভাবী হওয়ার অনুরোধ জানান।...

তীব্র গরমে ছয় বিভাগে স্বস্তির খবর

দখিনের সময় ডেস্ক: দেশজুড়ে গরমের হাঁসফাঁস পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আজ শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেওয়া পূর্বাভাসে...

সারা দেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট

দখিনের সময় ডেস্ক: দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহের তীব্রতা বাড়তে পারে এবং অব্যাহত থাকতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে ৩ দিনের জন্য সতর্কতামূলক হিট অ্যালার্ট...

ডাল-ভাত নয়, মানুষ এখন মাছ-মাংস নিয়ে চিন্তা করে: প্রধানমন্ত্রী

দখিনের সময় ডেস্ক: কৃষির উন্নয়নে সমবায় পদ্ধতি চালু করতে পারলে জীবনেও খাদ্যের অভাব হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ...

Recent Comments