Home শীর্ষ খবর নামেই হাসপাতাল, নেই ডাক্তার নেই নার্স

নামেই হাসপাতাল, নেই ডাক্তার নেই নার্স

দখিনের সময ডেস্ক:

কিশোরগঞ্জের নিকলি উপজেলার হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতাল। বিশাল ভবন। কিন্তু নেই ডাক্তার নেই নার্স। এটি কেবল নামেই হাসপাতাল। এখানে নেই কোনো চিকিৎসক, নার্স বা টেকনোলজিস্ট। ফলে চলছে এখানে চিকিৎসা সেবার নিতে এসে অনেকেই পড়ছেন বিপদে। মৃত্যুমুখে পতিত হবার ঘটনাও আছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই! নিয়মিত সেলামী নিয়েই চুপ থাকছেন সরকারি লোকেরা।

সম্প্রতি প্রসববেদনা নিয়ে স্থানীয় এক নারী ভর্তি হয়েছিলেন হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতাল।  তার স্বজনরা জানতেন না, এটি কেবল নামেই হাসপাতাল। এখানে নেই কোনো চিকিৎসক, নার্স বা টেকনোলজিস্ট। একপর্যায়ে বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই নারীকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে চান স্বজনরা। কিন্তু জোরপূর্বক তাদের আটকে রাখে হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিকেলে অন্য আরেক জায়গা থেকে ডাক্তার এনে সেই প্রসূতির সিজারিয়ান অপারেশন করানো হয়। এর পর রক্তের প্রয়োজন পড়ে। এ সময় ইচ্ছামতো গ্রুপ নির্ণয় করে সেই নারীর শরীরে রক্ত ঢোকানো হয়। এ পর্যায়ে ভুল গ্রুপের রক্ত প্রবেশ করানোয় ওই নারীর সারা শরীর ফুলে ওঠে এবং কিডনি বিকল হয়ে মুমূর্ষু হয়ে পড়েন। এর পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমে কিশোরগঞ্জ ও পরে ঢাকায় আনা হয়। সেই নারীকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হলেও তার বাচ্চাটিকে বাঁচানো যায়নি।

প্রায় তিন বছর আগে নিকলী উপজেলা হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড নামে এই বেসরকারি হাসপাতাল চালু হয়। সম্প্রতি নাম পরিবর্তন করে এর নাম রাখা হয় হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতাল। অথচ এখনো সেখানে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক নার্স ও প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট নেই। ফলে ভুল চিকিৎসা ও রোগী মৃত্যুর ঘটনা এখানে প্রতিনিয়তই ঘটছে। নিকলী সদর ইউনিয়নের মোহরকোনা গ্রামের উসমান গণির স্ত্রী রোজিনা আক্তার তেমনই এক ভুক্তভোগী। ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রসবব্যথা নিয়ে রোজিনা হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন সেখানে কোনো ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস্ট ছিল না। বিকালে একজন ডাক্তার এসে সিজারের কাজ শেষ করে চলে যান।

সন্ধ্যার পর রোজিনার রক্তের প্রয়োজন দেখা দিলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোজিনার রক্তের গ্রুপ এবি পজিটিভ নির্ণয় করে। সেই অনুসারে রোজিনার শরীরে এবি গ্রুপের রক্ত দেওয়া হয়। এর পর রোজিনার হাত-পা ফুলে ওঠে। একপর্যায়ে তার রক্তবমি শুরু হলে তিনি মুমূর্ষু হয়ে পড়েন। পরের দিন উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রথমে কিশোরগঞ্জ সদর ও পরে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার বেসরকারি ক্লিনিক মেডিসিন হেলথ কেয়ারের রিপোর্ট অনুযায়ী, রোজিনার রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ। ঢাকার চিকিৎসকরা জানান, হাবিয়া খাতুন ক্লিনিকে রোজিনার শরীরে ভুল করে এবি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত দেওয়ায় তার কিডনি বিকল হয়ে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়।

নিকলী সদর ইউনিয়নে শিবিরে বসবাসকারী আলম মিয়ার স্ত্রী সুমা আক্তারের প্রসবব্যথা শুরু হলে হাবিয়া খাতুন ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেদিনই ক্লিনিকে কোনো চিকিৎসক ছিল না। ক্লিনিকে ডাক্তার আসবে বলে সুমা আক্তারকে জোরপূর্বক দীর্ঘ সময় আটকে রাখে। এই সময়ে তার রক্তপাত শুরু হয়, এতে প্রসূতি ও গর্ভজাত শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ে। সন্ধ্যার পর সুমা আক্তারের আত্মীয়স্বজনের হল্লা করে তাকে ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে সুমা আক্তারের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জরুরি সাত ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের পরামর্শ দেয়। রক্ত জোগাড় হলে সুমার সিজার করা হয়। এক্ষেত্রেও সুমাকে বাঁচানো সম্ভভ হলেও তার মৃত সন্তান প্রসব হয়।

একইভাবে করগাঁও ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামের নাঈম এর স্ত্রী সুমির প্রসবব্যথা শুরু হলে ভোরে হাবিয়া খাতুন হাসপাতালে নিয়ে যান। ক্লিনিকে ডাক্তার আসবে আসবে বলে সুমিকে জোরপূর্বক সারাদিন আটকে রাখে। প্রসূতির শারীরিক অবস্থা কাহিল হয়ে পড়লে সন্ধ্যার পর সুমিকে অন্যত্র চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে দিলেও কোনো চিকিৎসা না করেই ৫ হাজার টাকা বিল আদায় করে।

চলতি বছরের ১৭ জুলাই হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতালের এসব অনিয়ম নিয়েই নিকলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন উপজেলার ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি মো. আবু জামান। তিনি বলেন, হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতাল রোগীদের বিল আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো ভাউচার দেয় না। উল্লিখিত অভিযোগ ছাড়াও ওই হাসপাতালে টেকনোলোজিস্ট ছাড়াই এক্স-রেসহ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ছাড়া নিজেরাই সব প্রকার পরীক্ষার আনুমাননির্ভর রিপোর্ট দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে আসছে। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত ক্ষমতাবান। তাদের ভয়ে কেউ অভিযোগ করতে সাহস পায় না। এমনকি স্থানীয় প্রশাসন এ ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নিকলী উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা ডা. সজীব ঘোষ বলেন, হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। এরই মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্ট হাতে এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগের বিষয়টি কিশোরগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন অফিসে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা থেকে জানা গেছে, হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতাল নামের কোনো হাসপাতাল অধিদপ্তরের নিবন্ধিত নয়। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে নিবন্ধন নিতে কোনো আবেদনও করা হয়নি। সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য হাবিয়া খাতুন জেনারেল হাসপাতালের প্যাডে যে ফোন নম্বর রয়েছে তাতে ফোন করা হলে নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

বাউফলে সড়ক নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ

নয়ন সিকদার, বাউফল প্রতিনিধি পটুয়াখালীর বাউফলে সড়ক প্রশস্তকরণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। চোখের সামনে প্রকাশ্যে দিবালোকে নির্মাণকাজে নিম্মমানের উপকরণ ব্যবহার করায় ক্ষুদ্ব প্রতিক্রিয়া...

টিকটকে নিরাপদ রাখবে যে ১০ ফিচার

দখিনের সময় ডেস্ক: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে টিকটক। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে টিকটক। যেখানে ‘ফিডস’ নেটওয়ার্কের...

প্রতিদিন খেজুর খাবেন যে কারণে

দখিনের সময় ডেস্ক: আপনার কি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য সুস্বাদু কোনো খাবার প্রয়োজন এবং সেইসঙ্গে অতিরিক্ত ওজন কমাতে চাইছেন? এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হতে পারে খেজুর।...

পরীমণি প্রথম স্বামীর পরদিন মারাগেলো প্রথম পরিচালক

দখিনের সময় ডেস্ক: লাইফ সাপোর্টে থেকেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ঢাকাই সিনেমার আলোচিত নায়িকা পরীমণির প্রথম সিনেমা ‘ভালোবাসা সীমাহীন’-এর পরিচালক শাহ আলম মণ্ডল।  গুলশানের...

Recent Comments