Home বিশেষ প্রতিবেদন বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন মনসুরুল আলম মন্টু

বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন মনসুরুল আলম মন্টু

ছাত্ররাজনীতি থেকে বেড়ে উঠেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আলম মন্টু। দেশের মানুষের দাবি আদায়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন তিনি। এ সময় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন একাধিকবার। রাজপথে তার মিছিলে গুলি হয়েছে। হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে বরিশাল রক্ষার অসম যুদ্ধে মৃত্যু দেখেন খুব কাছ থেকে। ভারত যাবার পথে পড়েছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গানবোটের কবলে।

সেবার ধরা পড়তে পড়তে সারেং-এর বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে গেলেও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়া থেকে আর বাঁচতে পারেননি। তবে সেবার প্রাণে বেঁচেছিলেন কৌশলে পালিয়ে এবং শুধু নিজের প্রাণ নয়, সতীর্থ সকলকে বাঁচিয়েছেন মনসুরুল আলম মন্টু। কাবু করেছিলেন রাজাকার দলকে।
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’-এই স্লোগানে মুখর ছিল ঊনসত্তরের মিছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের আলোকে স্বাধীনতার জন্য মানুষের একাগ্রতা, যুদ্ধে যাবার উৎসাহের জোয়ার সৃষ্টি হয় সারাদেশে। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্যপট! তখন সবাই ছিল স্বাধীনতাকামী। জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনসুরুল আলম মন্টু এই চিত্র দেখেছেন ভিতর থেকে। পাশাপাশি দৃশ্যপট পাল্টে যেতেও দেখেছেন তিনি।
উত্তাল সেই দিনগুলোতে মনসুরুল আলম মন্টু ছিলেন বরিশালের প্রথম সারির ছাত্রনেতা। ঊনসত্তরে ছিলেন বরিশাল শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ‘৭০সালে হয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। পাকিস্তানের দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি, অংশ নিয়েছেন বরিশাল দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে। বরিশালের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার পর ভারত গেছেন অধিকতর প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে মুখোমুখি হয়েছেন নানান বৈরী পরিস্থিতির। নানান সংকট কাটিয়ে দেরাদুনে ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এরপর বিএলএফের গর্বিত সদস্য হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন মনসুরুল আলম মন্টু।
ছাত্ররাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে যারা সক্রিয় হয়েছেন তাদের অন্যতম মনসুরুল আলম মন্টু। পরে যুক্ত হয়েছেন রাজনীতিতে। যদিও বহু বছর আগেই তাঁর উচ্চারণ হচ্ছে, ‘আজ আমি রাজনীতি থেকে অনেক দূরে।’ তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলো এবং মুক্তিযুদ্ধের নানান প্রসঙ্গ নিয়ে। এ নিয়ে ‘বরিশাল মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে’ নামে তাঁর একটি অসাধারণ বই রয়েছে।

দৈনিক দখিনের সময়-এর পাতায় নিমগ্ন মনসুরুল আলম মন্টু ও অধ্যাপক আলমগীর

উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- ঊনসত্তরের মিছিলে আমাদের এ স্লোগান হঠাৎ করেই বরিশাল স্তম্বিত হয়ে গিয়েছিল। বরিশালের একজন ক্রুদ্ধ কবি বলেছিলেন, ‘মিছিল যেন আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা আর বোদ্ধা মানুষগুলো যেন হিম শীতল পাথর।’ একটু আগেও যারা রুচিতার ছোট চায়ের কাপে তুফান তুলছিল রাজনীতির নানান জটিল তত্ত্ব-তর্কে তারা চলচ্চিত্রের ফ্রিজ ছবিতে পরিণত হয়ে গেলেন মুহূর্তে। তারা বললো, ‘বলে কি! দেশ স্বাধীন করবে? বাংলাদেশটা কোথায়? ওরা কি পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলছে? ওরা কি পাকিস্তান ভেঙে ফেলতে চাইছে?’
মনসুরুল আলম মন্টু জানালেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করার স্লোগান কেবল বোদ্ধারা নয়; আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন বরিশালের অনেক নেতাও। মিছিল শেষের উত্তেজনা নিয়ে আমরা এখানে-ওখানে গেছি, আমাদের নেতাদের চোখে-মুখে দেখেছি আতঙ্কের ছায়া। কেউ কেউ আমাদের একান্তে ডেকে নিয়ে বলেছেন, নিজেরা তো বিপদ হাতে নিয়েছো, আমাদের জন্যও গর্ত খুঁড়ছো। কেউ বললো, আত্মগোপন করো। কেবল একজন বলেছে, আমরা সাধারণ মানুষ যা ভাবি, কল্পনা করি, ছাত্রলীগ তা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করে দেয়। আর একজনের মন্তব্য ছিল, ছাত্রলীগ সময়ের এক ধাপ আগে চলে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা স্মরণ করে মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, আমরা সে সময় থেকেই বুঝতে চেষ্টা করেছি, ওরা কেন বলে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী। আর সেই অনুধাবনের তোড়ে আমাদের মগজে ঢুকে গিয়েছিল স্বাধীনতার আকাঙ্খা। আমরাও ওদের মতো আবিষ্কার করলাম, আসলে আমাদের অস্তিত্বের জন্য, আমাদের সংস্কৃতির জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, ধর্মের পবিত্রতার জন্য, জাতীয়তার জন্য স্বাধীনতাই মুক্তির একমাত্র পথ। আমরা থামিনি।

মুক্তিযুদ্ধের উপর মনসুরুল আলম মন্টুর অসাধারণ গ্রন্থ ‘বরিশাল মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে’

মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, আমরা এটা অনুভব করেছিলাম, যা হবার এখন থেকে সরাসরি হবে। আমরা ঘরে ফিরব না! পরের দিনের মিছিলের একই ধ্বনি প্রতিধ্বনি হলো। কয়েক দিন পর মিছিলে গুলি চলেছিল। সবাই বলেছিল সেদিনের মিছিলে ওরা ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে, গুলি তারই প্রতিক্রিয়া। অনেকেই মন্তব্য করেছিল, ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা আরও অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলাম। আরও বেশি জ্বলে উঠেছিলাম! গুলির পরের দিন মিছিল হয়েছিল সেই রকমই। বরিশালবাসী দেখেছে, আমরা গুলির পরোয়া করিনি। আমরা যা বলেছি তার একটি অক্ষর থেকেও বিচ্যুত হইনি।
মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, ১৯৬৬ সালে আমি স্কুলে থাকলেও চোখ খুলে দেখতে পাচ্ছিলাম বরিশালের ৬ দফার আন্দোলন। ১৯৬৮ সালে বিএম কলেজে ভর্তি হয়েছি। একদিকে আমার বাবার মৃত্যু অন্যদিকে বিএম কলেজের নতুন জীবন। বোধকরি, নিজকে বেশি করে ব্যস্ত করে ফেললাম ছাত্রলীগের কর্মকা-ে। এ সময় আমার আর একটি আশ্রয়স্থল ছিল। বন্ধু পান্নার বাসা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা অপারেশন শেষে আশপাশের সর্বত্র আক্রমণ চালাতে থাকে। বরিশাল আক্রমণ করেছিল সর্বশেষ অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল। এদিকে বরিশালে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয় ২৫ মার্চ রাত থেকেই। যার মানসিক প্রস্তুতি ছিল ৭ মার্চ থেকেই, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিক নির্দেশনা অনুসারে। এমনটাই জানিয়েছেন মনসুরুল আলম মন্টু।
বরিশালে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রসঙ্গে মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত বরিশালবাসীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে পুরো এক মাস সময় পাওয়া গেছে। এ সময় অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর শুরুতেই বরিশাল জেলা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। যার বেসামরিক বিভাগের প্রধান ছিলেন অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জলিল। ১৭ এপ্রিল বরিশালের আকাশে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। এদিকে সন্দেহভাজন একজনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। বরিশাল শহরে ১৮ এপ্রিল দুপুরের দিকে শুরু হয় বিমান হামলা। জঙ্গি বিমানের আক্রমণ যে কি ভয়াবহ তা বর্ণনা করা কঠিন। উপর থেকে মেশিনগানের আক্রমণের বিরুদ্ধে আমরা কিছুই করতে পারিনি। আমরা সেদিন বুঝতে পারলাম, জল ও স্থলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেও আকাশপথে আমরা একেবারেই নাজুক অবস্থায় আছি। বিষয়টি আমাদেরকে বেশ ভাবনার মধ্যে ফেলেছিল। সাধারণ মানুষেরও ধারণা পোক্ত হয়ে গিয়েছিল যে, পাক সেনারা শহর আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারবে না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধারও মনোবল খানিকটা ভেঙে গিয়েছিল বলে মনে হয়। এদিকে বিমান হামলার দিনই শুনলাম, মেজর জলিল, হিরু ভাই, হাবিলদার সিদ্দিক, জব্বার সুন্দরবন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদে গেছেন। তারা নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের একটি চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে তাঁরা অস্ত্র নিয়ে ফিরে আসেন। বরিশাল শহরে যা কোনোদিন দেখিনি সেই রকম কিছু অস্ত্রও দেখা গেল কারও কারও হাতে। আমরা বেশ অবাক চোখে দেখতাম। কিন্তু তখনও আমরা বুঝতে পারিনি, আমাদের আসল প্রয়োজন মাইন এবং গ্রেনেড আসেনি। আসেনি বিমানবিধ্বংসী কামান। বস্তুত প্রতিরোধ যুদ্ধে ওসবের প্রয়োজনই ছিল সবচেয়ে বেশি। এরপরও সকলেই দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন, যেভাবেই হোক বরিশাল স্বাধীন রাখতে হবে।
বরিশাল আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গে মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, ২৪ এপ্রিল ফরিদপুর দখল করার পর ২৬ এপ্রিল পাক বাহিনী বরিশাল আক্রমণ করে। পরিকল্পনা মতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরও পাক বাহিনীর প্রচ- গোলাবর্ষণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে পারছিলেন না। মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে ঝুনাহারের প্রতিরোধ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। শুনেছি বেলা ২টার দিকে মঞ্জু ভাই তালতলি এলাকা ছেড়েছেন। আমু ভাই আমাদের বললেন, জিপে ওঠো। আর থাকাটা ঠিক নয়।
মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, আমার মেজাজটা খারাপ ছিল। এটি মুক্তিযুদ্ধ! যার যার দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয়। শেষ মুহূর্তে পালাচ্ছি। এটা আগে করলে এতটা তাড়াহুড়া করতে হতো না। আমরা কালিজিরা পৌঁছে গেলাম অল্প সময়ের মধ্যে। বরিশালের এসপির লঞ্চটি নোঙ্গর করা ছিল। আমরা সেটিতে উঠে পড়লাম। এ লঞ্চে করেই আমরা ভারতের পথে যাত্রা করি। আমাদের লঞ্চটি কালিজিরার সন্ধ্যা নদী থেকে বেরিয়ে কেবলমাত্র কীর্তনখোলায় পড়েছি, হঠাৎ আওড়াবুনিয়া গ্রামের কাছাকাছি দেখি আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে পাকিস্তানি বোমারু বিমান। একটু ঘুরে আবার খুবই নিচু দিয়ে উড়ে গেল বিমানটি। এরপর আরও দুটি বিমান খুব নিচ দিয়ে আমাদের মাথার ওপর চক্কর খেলো। আমু ভাই লঞ্চ তীরে ভেড়াতে বললেন। আমরা সবাই লাফিয়ে লঞ্চ থেকে তীরে নেমে পড়লাম। একটি ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নেই। বিমান আর ফিরে না আসায় ডালপালা দিয়ে যতটা সম্ভব লঞ্চটি ঢেকে দিলাম। তারপর আবার ছুটলাম ঝালকাঠির দিকে। রাত দশটার দিকে ঝালকাঠি বন্দরের পাশে এটি খালের মধ্যে এসে লঞ্চ ভেড়ালাম। চাল-ডাল-মসলা-তেল ইত্যাদি কিনে নেই। সেখান থেকে রওয়ানা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গেল। এক পর্যায়ে মাথার কাছের ভেন্টিলেটর সরিয়ে বাইরে তাকালাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদ্যুতের মতো রক্ত প্রবাহ শুরু হলো। দেখলাম দুটি গানবোট! বেশ বড়। একটি চলে যাচ্ছিল অপরটির গতি কমিয়ে আমাদের লঞ্চের দিকে আসতে শুরু করে। এদিকে আমাদের লঞ্চের প্রতিটি জানালার কাছে একটি করে রাইফেল ও একটি করে গুলির পেটি রাখা ছিল। আমি হামাগুড়ি দিয়ে আমু ভাইর কেবিনে ঢুকে পড়লাম। আমরা দুজনই গানবোটের শব্দ শুনতে পেলাম। ভাবলাম, আর রক্ষা নেই। হঠাৎ মাথায় একটি বুদ্ধি এলো, খোলের মধ্যে তেল আছে সেখানে সব আর্মস ফেলা যায়। কার্পেট এবং পাটাতন সরিয়ে খোলের মুখটা বের করতেই আনিস তালুকদার কোথা থেকে এসে এক লাফে খোলের মধ্যে ঝাপ দিয়ে ঢুকে ডুব দিয়ে কোথায় যেন চলে যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাইফেল আর গুলির পেটিগুলো লঞ্চের খোলের মধ্যে ফেলতে লাগলাম। এদিকে গানবোটের শব্দ কমে গেলো। অর্থাৎ গানবোট থেমে গেছে। আমু ভাইকে দেখলাম, লুঙ্গি ঠিক করতে করতে এসে আমার কাছে দাঁড়ালো। তার চোখ নিষ্প্রভ। বলেন, ‘মন্টু আর্মি আমাদেরকে মেরে ফেলবে!’
মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, আমার ভেতরটাও তখন তোলপাড়। তারপরও বললাম, আমু ভাই আপনি এমপি, আপনাকে মারবে না। মারবে তো আমাদের! আমি আর দেরি করলাম না। আমু ভাইকে ধরে তার কেবিনে নিয়ে গেলাম। তাঁকে এক রকম জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। আমু ভাইও শান্ত ছেলের মতো বিছানায় শুয়ে থাকলেন।
পাক বাহিনীর গানবোটের কবলে পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়া প্রসঙ্গে মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, লঞ্চের খোলের পাটাতন টেনে কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর লঞ্চে ঢোকার পথে থাকা স্টোর রুমে গিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি। ওখান থেকে সারেংসহ সব কিছু এবং গানবোটের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। হাতে রিভলবারটা বাগিয়ে রাখলাম। যদি আর্মি এসেই পড়ে তাহলে একটা মেরেই মরবো। এই ভাবনার মধ্যেই আমাদের লঞ্চের সারেং-এর কণ্ঠ শুনলাম। বেশ জোরে জোরেই বললো, ‘ইয়ে আলতু মেয়া কা লঞ্চ হ্যায়। জি জি আলতু মেয়া, ভোলার আলতু মেয়া। ব্যবসা, বিজনেসম্যান হ্যায়।’ আর্মি জিজ্ঞেস করলো ‘কিতনা আদমী হ্যায় লঞ্চ মে?’ সারেং জবাব দিলো, ‘পাঁচ আদমি হ্যায়।’
মনসুরুল আলম মন্টু বললেন, ভাবলাম সারেং হয়তো আমাদের কথাই বলেছে। কেননা আমরাও পাঁচজন ছিলাম। তখন মাথায় আসেনি, লঞ্চের সুকানি খালাসি ছিল পাঁচজন। আর্মি বললো, ‘পর্দা হটাও।’ সারেং একটি একটি করে পর্দা সরিয়ে দেখাতে লাগলো। বোধকরি ওদের সন্দেহ যাচ্ছিল না। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে বললো, ‘ঠিক হ্যায়, জাহাজ গানবোট কা সাথ লাগাও।’ সারেং আদেশ মানার ভাব করে বললো, ‘কি করে বাঁধেঙ্গা, লঞ্চকা ইঞ্জিন একটু গরবর হ্যায়। আপ ঠেরিয়ে, একটু পরই ঠিক হয়ে যায়েগা। হামলোগ ইঞ্জিনকা কাম কর রাহা হ্যায়। আপলোক ঠেরিয়ে, ঠিক কর রাহা হ্যায়, কুচ গরবার।’ আর্মি বললো, ‘ঠিক হ্যায় তোমলোগ মেরামত করতে রহো। হামলোক আ রাহা হ্যা।’ এরপর গানবোট শব্দ করে উঠলো। আমাদের সারেং লম্বা করে একটা সালাম দেয়। গানবোট চলতে শুরু করলো। আমরা প্রাণে বাঁচলাম। আমু ভাই বললেন, ‘তাড়াতাড়ি জমিনে চলো।’
মনসুরুল আলম মন্টু বললেন, হাতের পোটলাপুটলি নিয়ে আমরা লঞ্চ থেকে নেমে পড়লাম। পেছনে যে তেল-রাইফেল- পেটিপিটি গুলি রেখে গেলাম লঞ্চের খোলে কেরোসিনের মধ্যে, তা আমাদের কারও মাথায় খেললো না। এদিকে গানবোটের খবর হয়ে গেছে গ্রামের মধ্যে। আমরা বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক খানের শেখেরহাটের বাড়িতে উঠলাম। পরদিন নৌকায় করে আমরা আবার ভারতের পথে রওয়ানা করি। আমরা ছিলাম ৬-৭ জন।

মনসুরুল আলম মন্টুর বই ‘বরিশাল মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে’-এ নিমগ্ন খান আলতাফ হোসেন ভুলু

তবে সেই যাত্রায় ভারত যাওয়া হয়নি মনসুরুল আলম মন্টুর। ফিরে আসলেন বরিশাল শহরে। এর কিছু দিন পর মনসুরুল আলম আবার ভারতের পথ ধরলেন। এবার পড়লেন রাজাকারের কবলে! ভারতের কাছাকাছি গিয়ে রাজাকারের হাতে ধরা পড়া প্রসঙ্গে মনসুরুল আলম মন্টু বললেন, সূর্য ডুবছে কেবল। দেখলাম বিপরীত থেকে দুটি নৌকা আমাদের নৌকার দিকে আসছে। হঠাৎ দেখতে পেলাম নৌকা থেকে ৭-৮ জন রাইফেলধারী বেরিয়ে এলো। চিৎকার করে বললো, ‘নৌকা থামাও, না হলে গুলি করে দেব।’ ওরা আমাদের নৌকাগুলো ওদের নৌকার সঙ্গে বেঁধে একটা খালের ভেতর নিয়ে এলো। নৌকা থেকে নামিয়ে আমাদের লাইন করিয়ে দাঁড় করালো। বুঝলাম, আমরা রাজাকারের হাতে ধরা পড়েছি। বুড়ো রাজাকার আমাদের সামনে অনেকটা রাজকীয় ভঙ্গিতে পায়চারী করতে করতে একটা দীর্ঘ ভাষণ দিল।
মনসুরুল আলম মন্টু বললেন, সেদিনের অত্যাচারের কথা জীবনে ভুলব না। আমাদেরকে পিছমোড়া হাত বেঁধে চিত করে রাখা হয়েছিল। রাত তখন গভীর। আমি হাত খোলার চেষ্টা শুরু করলাম। কি করে পিছমোড়া হাতের বাঁধন খুলতে হয় সে ট্রেনিং লালকুটি ক্যাম্পে দেওয়া হয়েছিল। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাতের বাঁধন শিথিল করে ফেললাম। অন্ধকারে গড়িয়ে গড়িয়ে একে একে সকলের কাছে গিয়ে বাঁধন খুলে দেই। এর পর একটু একটু ক্রোলিং করে আমরা অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। রাজাকাররা একটা গাছের নিচে ঝিমাচ্ছিল। সবাই মিলে ওদের কাবু করে হাত-পা বেঁধে ফেললাম। আমরা নৌকায় উঠে আবার যাত্রা শুরু করি। রাজাকাররা এক পর্যায়ে টের পেয়েছিল। কিন্তু আমাদের আর ধরতে পারেনি।
মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় কখন যে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করেছি তা বলতে পারি না। আমরা ভারতের সীমান্ত রক্ষী বিএসএফের হাতে পড়লাম। ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর বিএসএফ আমাদেরকে বনগাঁও বাংলাদেশের অফিসে যেতে বললো। রাস্তাও দেখিয়ে দিল। এরপর বাস-ট্রেন ধরে টাকিতে পৌঁছলাম। আগস্ট মাস। তখন প্রায় সন্ধ্যা। একে ওকে জিজ্ঞেস করে টাকি কাম্পের সামনে পৌঁছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে বরিশালের কেউ আছে? গার্ড বললো, সবাই তো বরিশালের, আপনি কার সঙ্গে দেখা করতে চান? আমার কথা শুনে একজন ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই দেখি অন্ধকারের মধ্যে হাফপ্যান্ট পরা একজন দৈত্যের মতো লোক গেটের দিকে দৌড়ে আসছে। আমাদের মোস্তফা ভাই। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ভিতরে নিয়ে গেলেন। কয়েকদিন পর মোস্তফা ভাই আমাকে কলকাতায় সানি ভিলায় নিয়ে গেলেন। সেখানে আমু ভাইর পাশে থাকার ব্যবস্থা হয়। শুরু হয় প্রশিক্ষণের অপেক্ষা। কিছুদিন পর আমার প্রতীক্ষার অবসান হয়। তোফায়েল ভাই আমার জন্য ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলেন। মনে হলো, ব্যারাকপুরে বেশ বেছে বেছে মুক্তিযোদ্ধাদের নেওয়া হয়েছে। আমাদের জোর ট্রেনিং চললো। অল্প সময়ের বড় কষ্টের ট্রেনিং! বলতে গেলে সারাটা দিন আমাদেরকে ঘড়ির ওপর চলতে হতো। আমাদেরকে ট্রেনিং দিতেন কয়েকজন ভারতীয় আর্মি সুবেদার। তবে মূল দায়িত্বে ছিলেন মেজর গুহ রায়। অক্টোবর-নভেম্বর গেল প্রশিক্ষণে। আমাদের ট্রেনিং শেষ হয় ২৯ নভেম্বর। আমরা একদিন বিশ্রামের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা মুজিববাহিনী। ট্রেনিং শেষে মুজিববাহিনীর সদস্য হিসেবে ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে আমরা বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করি। এদিকে আমাদের আগে মুজিব বাহিনীর যে গ্রুপটি দেরাদুনে ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিল তারা সবাই পাক সেনাদের হাতে নিহত হন। একমাত্র বরিশালের আমবাগানের মফিজুল ইসলাম ঝন্টু বেঁচে আছেন। ঝন্টু ভাই অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন।
মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল বরিশাল। নৌকায় করে যশোর-ফরিদপুর হয়ে বরিশাল। এ দলের কমান্ডার ছিলাম আমি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে আমাদেরকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, বরিশাল হানাদারমুক্ত করা। এদিকে বরিশালে অনেক দল সক্রিয় ছিল। আর বরিশাল মুজিববাহিনী প্রধান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ গৌরনদীতে মুজিববাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছেন। তিনি কয়েকটি আক্রমণের নেতৃত্ব দেন এবং বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করে রাজাকার ও মিলিশিয়াদের কয়েকটি শক্তিশালী ঘাঁটির পতন ঘটিয়েছেন। আমাদের লক্ষ্য, তার সঙ্গে মিলিত হওয়া। নৌকা ও হেঁটে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আমরা বরিশাল মুজিববাহিনী প্রধান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কাছে গিয়ে রিপোর্ট করি।
বরিশালের মাটিতে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, হাসানাত ভাই গৌরনদী কলেজে অবস্থান নেওয়া পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমরা তিন দিক থেকে হামলা শুরু করি। বেশ কয়েকদিন আক্রমণ চললো। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু তারা খবর পাঠালো, কোনো অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আত্মসমর্পণ করবে না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছেই তারা আত্মসমর্úণ করবে। এদিকে হাসানাত ভাই আমাদেরকে বরিশালের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিলেন। মনসুরুল আলম মন্টু বললেন, তখন আমাদের কাছে প্রচুর অস্ত্র ছিল। আমরা বেশ সাহসের সঙ্গে এগিয়েছি। পথে কয়েকটি রাজাকার ক্যাম্প আমাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হলো। সে সময় শত শত সাধারণ মানুষও আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। চারদিকে কেবল আমাদের জয়ধ্বনি। উজিরপুরের মধ্য দিয়ে সুগন্ধা নদী পার হয়ে কড়াপুরের রাস্তায় চলে আসি। হরিণাফুলিয়া-কুদঘাটা পার হয়ে নবগ্রাম আসতে আমাদের তেমন সময় লাগেনি। নবগ্রাম এসে জানতে পারলাম, বরিশালে আমাদের আর কিছুই করার নেই। কেননা পাক সেনারা কয়েকটা স্টিমার ও লঞ্চে ঢাকার দিকে পালিয়েছে। খবর পেলাম, তাদের জাহাজগুলো শায়েস্তাবাদের কাছে ভারতীয় বিমান হামলার শিকার হয়েছে।

মনসুরুল আলম মন্টুর সঙ্গে আলাপ করছেন লেখক আলম রায়হান

মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, খবর পেলাম মিলিটারি চলে গেলেও আলবদর ও আল শামসরা ত্রিশ গোডাউন এবং ওয়াপদা বিল্ডিং-এ অবস্থান করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যাবার সময় তাদের বলে গেছে, ঢাকায় যুদ্ধ করে তারা ফিরে আসবে। এ ছিল আসলে ধাপ্পা। শুধু তাই নয়, রাজাকারদের বলে গেছে, কোনো অবস্থাতেই তারা যেন আত্মসমর্পণ না করে। হানাদার বাহিনী বরিশাল ছাড়ার আগে শহরে কারফিউ দিয়েছিল। এরপর মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে পাকিস্তান বাহিনী বরিশাল ছাড়ে। পরদিন সকাল হতে না হতেই বরিশাল শহরের আশপাশের মুক্তিযোদ্ধারা জয়বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে শহরে প্রবেশ করতে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় জনতা। আমরা ক্যাম্প করলাম বরিশাল কলেজে।
হানাদারমুক্ত বরিশালে সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে মনসুরুল আলম মন্টু বলেন, বরিশালের কীর্তনখোলার তীরে দাঁড়িয়ে বুক ভরে দম নিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে তার গভীর আবেগের প্রশ্ন, কত বছর পর? হাজার বছর পর? এরপর তার হতাশার প্রশ্ন, সেই নিশ্বাস প্রশ্বাসের নির্মল হাওয়া এখন কোথায়?

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

কেবল সুইসাইড নোটে শাস্তি হয় না

দখিনের সময় ডেস্ক বিরাজমান আইনে  শুধু সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে শাস্তি দেয়া যায় না। তবি এটি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হয়। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২–এর ৩২...

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে বিশাল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, নেবে ৩০১৭ জন

দখিনের সময় ডেস্ক: ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন জোনাল সেটেলমেন্ট ও উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসের রাজস্ব খাতভুক্ত ১৫টি পদে ৩...

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগ, এসএসসি পাসেই আবেদন

দখিনের সময় ডেস্ক: নাটোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শূন্য পদে লোকবল নিয়োগের জন্য এ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। ১৭ মার্চ থেকে আবেদন...

ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তায় নতুন ফিচার নিয়ে আসছে হোয়াটসঅ্যাপ

দখিনের সময় ডেস্ক: নতুন নতুন ফিচার নিয়ে সবসময় এগিয়ে থাকে হোয়াটসঅ্যাপ। ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখতেই এবার নতুন ফিচার যুক্ত হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে। মেটার মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপ...

Recent Comments