পুলিশের চক্করে স্কুল ছাত্রীর ২৬ বছর কারাভোগ, ডিসির বিচক্ষণতায় মুক্তি
দখিনের সময়
প্রকাশিত জুন ২৮, ২০২১, ০৭:১৪ পূর্বাহ্ণ
সংবাদটি শেয়ার করুন...
দখিনের সময় ডেস্ক:
দখিনের সময় ডেস্ক: একটা কথা আছে, ‘পুলিশ কী না পারে।’ এটি আবার প্রমানিত হলো পিয়ারা বেগমের বেলায়। এক দারোগার শিখানো বুলিতে পঞ্চমশ্রেনীর ছাত্রী পিয়ারা জাবজ্জীবন হয়। ২৬ বছর জেল খেটেছে। পর বরিসালের জেলা প্রশাসনক জসীমউদ্দিন হায়দারের বিচক্ষনতায় মুক্তি পেয়েছে পিয়ারা বেগমের।
পিয়ারা বেগম জানালেন পুলিশের চক্করে পড়ে জীবনের ২৬টি বছর কারাগারে কাটাবার কাহিনী। তিনি বলেন, ‘আমার স্কুলের ক্লাসে এক দারোগা গিয়া বলে পিয়ারা কে? বলি, আমি। দারোগা বলেন, তোমার বোন পুকুরে ডুবে মারা গেছে, তুমি জানো? আমি বলি, স্যার আমি এসব কিছুই জানি না। এরপর আমাকে মঠবাড়িয়া থানায় নিয়া যায়। দারোগা অনেক কথা বলে, ভয় দেখায়। বলে আমি যদি না বলি আমার বোনকে পুকুরে ফেলে দিয়েছি, তা হলে আমাকে ছাড়বে না। দারোগার শেখানো কথা আমি সবার কাছে বলি। এরপর আমার জেল হয়। আসলে আমি আমার বোনকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলি নাই। তার মৃত্যুর বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না।’
দারোগার শেখানো বুলিতে জেলে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মিরুখারী গ্রামের ছোট হারজি গ্রামের মৃত আনিস মৃধার ছোট মেয়ে ২৬ বছর জেল খাটা পিয়ারা আক্তার (৩৮)। গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক জসীমউদ্দিন হায়দারের বিশেষ বিবেচনায় চার বছর দণ্ড মওকুফের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ জুন মুক্তি পান তিনি।
পিয়ারা বলেন, আমার জীবনের আর কিছুই রইল না। যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করেছি। যখন আমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল তখন আমি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ১৯৯৫ সালের ঘটনা। স্কুলে একটি অনুষ্ঠান ছিল। সকাল বেলা উঠে আমি স্কুলে চলে যাই। সেদিন ক্লাসেই ছিলাম। বিশ্বাস করেন; আমি কিছুই জানতাম না। পুলিশের সেই দারোগার নাম স্মরণ নেই উল্লেখ করে পিয়ারা বলেন, তখন তো ছোট ছিলাম। তার নাম মনে নেই। কালো ও মোটা ছিলেন। তিনি অনেক পান খেতেন।
পিয়ারা বলেন, দারোগা আমাকে শিখিয়ে দেন, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেন বলি, বোনকে পুকুরে ধাক্কা মেরে আমি ফেলে দিয়েছি। তা হলে আমাকে ছেড়ে দেবে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তার (দারোগা) শেখানো কথাই বলেছি। কিন্তু আমাকে ছাড়েনি। তখন আমাকে পিরোজপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে ছিলাম দুই বছর। ১৯৯৭ সালের ২৪ এপ্রিল আমাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসা হয় বরিশাল কারাগারে। আর এখানে ২৬ বছর কারাভোগ করেছি। আরও চার বছর ছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসক স্যার বিবেচনা করে সাজা মওকুফ করে দিয়েছেন।
নেপথ্যে জমির বিরোধ:
পিয়ারা বলেন, ‘আমার চাচা তো বোন পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল সত্য। কিন্তু আমার আব্বার সঙ্গে বড় চাচা জহুরুল হক মৃধার জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল। আমাদের জমি দিচ্ছিলেন না চাচা। পরে বুঝতে পেরেছি, মেহজাবিনের মৃত্যুর ঘটনায় তারা আমাদের ফাঁসিয়েছে। ওই জমি আজ পর্যন্ত আমরা পাইনি।
মুক্তি পেয়ে মঠবাড়িয়ায় ফিরে গিয়ে পিয়ারা দেখেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ মা ছফুরা বেগম একাই বসবাস করছেন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি স্বামীর বাড়িতে থাকেন। আর ভাই দিনমজুরি করে জীবনযাপন করছেন। তিনিও আলাদা থাকেন।
মামলা চালাতে নিঃস্ব পরিবার
আফসোস করে পিয়ারা বলেন, ‘আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ভাইয়েরা যতটুকু সম্পত্তি ছিল তাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হয়নি। এখন তো আমরা নিঃস্ব। জীবন শেষ হইয়া আসছে। আর কয়ডা দিন বাঁচমু। নামাজ-রোজা করা ছাড়া আমার আর কোনো কিছু করার ইচ্ছা নেই।’
পিয়ারা বলেন, বরিশালের জেলা প্রশাসক স্যার আমাকে ডেকে পাঠাইছে। বৃহস্পতিবার একটি সেলাই মেশিন দিয়েছে। এখন বরিশালে একজনের বাসায় আছি। জেলা প্রশাসন নাকি আমাকে একটি চাকরি দেবেন। এখন গিয়ে দেখি কী চাকরি দেয়। আমার শরীর তো আর ভালো নেই, চাকরি কি করতে পারমু?