ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও মনসুরুল আলম মন্টু, মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের দুই দিকপাল

আলম রায়হান:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের আলোকে সামগ্রিক প্রস্তুতি নেয় বরিশাল।  গঠিত হয় বরিশাল জেলা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম  ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন এবং মনসুরুল আলম মন্টু। তাঁরা রাজনীতিক, আইনজীবী ও  লেখক।

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন

বরিশালে গঠিত জেলা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচারের দায়িত্ব পান ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন।  উত্তাল  সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন মনসুরুল আলম মন্টু। একই  সময় তিনি ছিলেন বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তৎকালীন বরিশাল জেলা হচ্ছে আজকের ৬ জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ।

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। এমনকি ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ভোলায় বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া আসনে তাকে মনোনয়ন দেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাকে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ ফোরাম সভাপতিমন্ডলীর সদস্য করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ইউসুফ হোসেন এবাধারে রাজনীতিক ও আইনজীবী। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়ে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন  ১৯৭১ সালে তরুণ আইনজীবী হিসেবে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন এবং বরিশালের বিভিন্ন গ্রামে–গঞ্জে জনমত গড়ে তোলেন। বাঙ্গালিদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন। ছাত্রনেতা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বরিশাল ও ঢাকার বিভিন্ন রণাঙ্গনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঢাকা ও বরিশালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক হিসেবে তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি লাভ করেন।

মনসুরুল আলম মন্টু।

দেশের মানুষের দাবি আদায়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন মনসুরুল আলম মন্টু। তিনি বেড়ে উঠেছেন ছাত্ররাজনীতি থেকে। ছাত্র রাজনীতি, স্বাধীকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ- তিন পর্বেই মনসুরুল আলম মন্টু ছিলেন অগ্র পথিক। এ সময় তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন একাধিকবার।

 ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’-এই স্লোগানে মুখর ছিল ঊনসত্তরের মিছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের আলোকে স্বাধীনতার জন্য মানুষের একাগ্রতা, যুদ্ধে যাবার উৎসাহের জোয়ার সৃষ্টি হয় সারাদেশে। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্যপট! তখন সবাই ছিল স্বাধীনতাকামী। জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনসুরুল আলম মন্টু এই চিত্র দেখেছেন ভিতর থেকে। পাশাপাশি দৃশ্যপট পাল্টে যেতেও দেখেছেন তিনি।

উত্তাল সেই দিনগুলোতে মনসুরুল আলম মন্টু ছিলেন বরিশালের প্রথম সারির ছাত্রনেতা। ঊনসত্তরে ছিলেন বরিশাল শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ’৭০ সালে হয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। পাকিস্তানের দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি, অংশ নিয়েছেন বরিশাল দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে। বরিশালের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার পর ভারত গেছেন অধিকতর প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে মুখোমুখি হয়েছেন নানান বৈরী পরিস্থিতির। নানান সংকট কাটিয়ে দেরাদুনে ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এরপর বিএলএফের গর্বিত সদস্য হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন মনসুরুল আলম মন্টু। অংশ নিয়েছেন একাধিক যুদ্ধে।

হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে বরিশাল রক্ষার অসম যুদ্ধে অসংখ্য মৃত্যু দেখেন খুব কাছ থেকে। ভারত যাবার পথে পড়েছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গানবোটের কবলে। সেবার ধরা পড়তে পড়তে সারেং-এর বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে গেলেও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়া থেকে আর বাঁচতে পারেননি। তবে সেবার প্রাণে বেঁচেছিলেন কৌশলে পালিয়ে এবং শুধু নিজের প্রাণ নয়, সতীর্থ সকলকে বাঁচিয়েছেন। কাবু করেছিলেন রাজাকার দলকে।

ছাত্ররাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে যারা সক্রিয় হয়েছেন তাদের অন্যতম মনসুরুল আলম মন্টু। পরে যুক্ত হয়েছেন রাজনীতিতে। যদিও বহু বছর আগেই তাঁর উচ্চারণ হচ্ছে, ‘আজ আমি রাজনীতি থেকে অনেক দূরে।’ ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলো এবং মুক্তিযুদ্ধের নানান প্রসঙ্গ নিয়ে ‘বরিশাল মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে’ নামে মনসুরুল আলম মন্টু  একটি অসাধারণ বই রয়েছে।