Home আন্তর্জাতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কেন এখন মধ্যস্থতা করতে চায় চীন?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কেন এখন মধ্যস্থতা করতে চায় চীন?

দখিনের সময় ডেস্ক:
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পেরোনোর পর এই সংঘাত অবসানে এখন চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে চাইছে। শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এই যুদ্ধ নিরসনে ১২টি পয়েন্ট সম্বলিত একটি নীতিমালাও ঘোষণা করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নীতিমালায় রাশিয়া- ইউক্রেন—দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা, দু’দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখানো এবং হানাহানি বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের অভিযোগ—চীন একদিকে মস্কোকে সমর্থন করছে এবং অন্যদিকে নিজেকে নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। ইউক্রেন থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিতে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবেও ভোটদান থেকে বিরত ছিল চীন।
বিবিসির বিশ্লেষণে চীনের এই অবস্থানের পেছনে কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো—
ইউরোপের মন জয়ের চেষ্টা
বিবিসির চীন শাখার সংবাদদাতা টেসা ওয়ং লিখছেন, গত এক বছরে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে চীনের সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করেছে। সে সময় তাতে তেমন সাড়া দেয় নি বেইজিং।
শুক্রবার নীতিমালা ঘোষণার মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসানে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সবল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকার। তবে বেইজিংয়ের বর্তমান এই অবস্থান অনেক পশ্চিমা দেশের পছন্দ না ও হতে পারে বলে মনে করেন টেসা ওয়ং।
সম্প্রতি চীনের শীর্ষ রাষ্ট্রদূত ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইউরোপ সফর করেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মন জয় করাই ছিল এ সফরের উদ্দেশ্য। অবশ্য সেই উদ্দেশ্য কতখানি পূরণ হয়েছে— তা প্রশ্নসাপেক্ষ, কারণ সফরটি শেষ হয়েছে মস্কোতে, ওয়াং ই’কে ভ্লাদিমির পুতিনের উষ্ণ অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে।
প্রসঙ্গত, ইউক্রেন প্রশ্নে চীন মূলত একটি নয় বরং দুটি অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছে—প্রথমটি, যুদ্ধের অবসানে চীনা সমাধানের প্রস্তাব, এবং অন্যটি, বিশ্ব-শান্তির লক্ষ্যে এক পরিকল্পনার রূপরেখা। এসব মূলত চীনা বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি, যা গত এক বছর ধরে চীনের প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূতরা বলে আসছেন। এতে রয়েছে: (ইউক্রেনের জন্য) সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান এবং (রাশিয়ার) জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষা করে (যুক্তরাষ্ট্রের) একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করা।
বেইজিংয়ের এই অবস্থা পশ্চিমা দেশগুলোকে হয়তো খুশি করবে না, কিন্তু তাদের খুশি করা কখনই চীনের প্রধান লক্ষ্য ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সুস্পষ্ট বার্তা’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের যা লক্ষ্য তা হচ্ছে প্রথমত, বিশ্বের শান্তিরক্ষক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করা। তারা আসলে কাকে দলে টানতে চাইছে সেটার সুস্পষ্ট ইংগিত রয়েছে তাদের একটি দলিলে যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা – অর্থাৎ তথাকথিত গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে চীন বিশ্বের বাদবাকি সেইসব দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে, যারা এখন নজর রাখছে পশ্চিমা দেশগুলো কীভাবে ইউক্রেন সংকট মোকাবেলা করে তার ওপর। চীনের আরেকটি লক্ষ্য হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা পাঠানো।
ব্রিটেনের নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং চীন-রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আলেকজান্ডার কোরোলেভ বলছেন, ‘চীনের সাম্প্রতিক অবস্থানের মধ্যে বিরুদ্ধাচরণের স্পর্ধা দেখানোর একটি ব্যাপারে রয়েছে।”
‘এটি বার্তা দিচ্ছে—আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের) মধ্যে সম্পর্ক যদি খারাপ হয়, তাহলে আমরা অন্য কারও কাছে যেতে পারি এবং রাশিয়া একা নয়। যদি যুদ্ধ বেঁধেই যায় তখন আমরাও একা থাকব না … তাই ধমকা-ধমকি করে পার পাবেন না।’
নেতৃত্বের সুযোগ, নাকি অন্য লক্ষ্য
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক এখন সবচেয়ে তিক্ত। সম্প্রতি এটি আরও খারাপ হয়েছে বেলুনকাণ্ডের পর। ফলে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাকি—চীন কেন ঠিক এই সময়টাতে ইউক্রেনের শান্তির জন্য কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে।
‘নেতৃত্ব দেওয়া বা প্রদর্শণের জন্য যথেষ্ট সুযোগ চীনের ছিল,” বিবিসিকে বলেন ড. কোরোলেভ, ‘লড়াইয়ের অবসান ঘটাতে ভূমিকা রাখার জন্য প্রথম দিকেই তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল … যদি সত্যি তাদের লক্ষ্য থাকতো বিশ্বনেতা হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ে তোলা, তাহলে গত একটি বছর দেশটি দর্শকের ভূমিকায় থাকতো না।’
এই অধ্যাপকের মতে, চীনের তৃতীয় একটি লক্ষ্য রয়েছে, এবং ওয়াং ই’র ভ্রমণ-সূচি থেকে তা বোঝা যায়।
‘ফ্রান্স- জার্মানি- ইতালি- হাঙ্গেরি, অর্থাৎ ইউরোপের যেসব দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে কম কঠোর বলে চীন বিশ্বাস করে, সেসব দেশ সফরের মাধ্যমে হয়তো ওয়াং ই ইউরোপের কিছু অংশকে চীনা বলয়ের প্রতি প্রলুব্ধ করতে চাইছেন,’ বিবিসিকে বলেন ড. কোরোলেভ।
মিউনিখে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা
ইস্ট চায়না নর্মাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ঝ্যাং শিন ড. কোরোলেভের বক্তব্যকে সমর্থন করে বিবিসিকে বলছেন, ইউরোপের কয়েকটি দেশের সঙ্গে স্বার্থের যৌক্তিক মিলন দেখতে পাচ্ছে বেইজিং।’
‘চীন বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্র একটি আধিপত্যবাদী শক্তি এবং তার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে ট্রান্সআটলান্টিক বিশ্বের একটি বড় অংশ হয়তো উপকৃত হবে।“
কিন্তু সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে চীন আদৌ সফল হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ওয়াং ই’র যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর মিত্ররা ভালভাবে গ্রহণ করেনি, এবং কূটনীতিকদের মতে, এই ভাষণ শুধুমাত্র চীনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবিশ্বাসের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনেকটা খোলাখুলিভাবেই ওয়াং ই বলেছেন, ‘ইউরোপের সঙ্গে আমাদের কোন সমস্যা নেই, মূল সমস্যা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। ইউরোপীয়দের সঙ্গে যেসব মত-পার্থক্য আমাদের রয়েছে, সেসব আমরা দূর করতে পারি এবং আপনাদের বুঝতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র আপনাদের সমস্যাপূর্ণ রাস্তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
তবে জার্মানির থিংক ট্যাংক সংস্থা মার্শাল ফান্ডের ইউরোপ-চীন সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ও সংস্থার সিনিয়র ফেলো অ্যান্ড্রু স্মল মনে করেন ওয়াং ই’র এই বক্তব্য সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এই বার্তায় সাড়া দেবে— এমনটা আমার মনে হয় না।’
রাশিয়াকে অস্ত্র দেবে চীন?
এখন মূল প্রশ্ন হলো, রাশিয়ার সঙ্গে পূর্ণ মিত্রতা বজায় রেখে ইউক্রেন ইস্যুতে শান্তি স্থাপনে চীন তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারবে কিনা।
যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সতর্ক করেছে যে চীন রাশিয়াকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করার কথা বিবেচনা করছে, এবং চীনা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই রাশিয়াকে সমরাস্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রযুক্তি সরবরাহ করা শুরু করছে। এসব যন্ত্রপাতি বেসামরিক এবং সামরিক দু’ভাবেই ব্যবহার করা যায়, যেমন ড্রোন এবং সেমি-কন্ডাকটর।
যুক্তরাষ্ট্রের এই বক্তব্যের জবাবে প্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। অবশ্য রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ওয়াং ই ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতি বিভাগের প্রধান জোসেপ বোরেলকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন—বেইজিং রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করবে না।
তবে জানা গেছে, তিনি বরেলকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনারা যেখানে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছেন সেখানে আমরা রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করছি কিনা, তা নিয়ে কেন উদ্বেগ বোধ করছেন কেন?” পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই বাক্যটির মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে চীনা সরকার এখনও সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করে যে এই যুদ্ধে ইন্ধন জোগানোর জন্য পশ্চিমারাই দায়ী।
‘যুদ্ধরত কোন এক পক্ষের কাছে অস্ত্র পাঠানো লড়াই বৃদ্ধির প্রচেষ্টা হিসাবে বিবেচনা করা হয় – এখন পর্যন্ত এটাই চীনের অবস্থান,’ বিবিসিকে বলছেন ড. ঝ্যাং।
চীনা কৌশলের ঝুঁকি
বেইজিং শেষ পর্যন্ত মস্কোকে অস্ত্র সরবরাহ করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, কারণ তাহলে তা চীনা স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে।
অন্যরা এ ধরনের পদক্ষেপকে সংঘাত বৃদ্ধি হিসাবে দেখবে এবং নিষেধাজ্ঞা ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যে আরও ব্যাঘাত ঘটবে, যা চীনের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর কারণ হবে। ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র এখনও চীনের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদারদের অন্যতম।
এছাড়া এতে বিশ্বব্যাপী উত্তেজনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে এবং সম্ভবত মিত্রদেশগুলোকে আরও বেশি করে আমেরিকার বলয়ের দিকে ঠেলে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে এসব দেশকে কাছে টানার চীনা কৌশলটি তখন নস্যাৎ হয়ে যাবে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, যেটা ঘটার সম্ভাবনা বেশি—তা হলো বেইজিং সরকার রাশিয়ার প্রতি পরোক্ষ সমর্থন অব্যাহত রাখবে কিংবা বাড়িয়ে দেবে। যেমন, অর্থনৈতিক বাণিজ্য যা মস্কোর অর্থনৈতিক জীবনের একটি চাবিকাঠি। তারা একই সাথে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেকোন নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে থাকবে।
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ক’দিন আগে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছিলেন যে দু’দেশের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব সীমাহীন।’
সেই বিশেষ বন্ধুর জন্য চীন আর কতদূর যেতে পারে, এক বছর পর চীনকে সেই প্রশ্নের উত্তরও দিতে হবে।
সূত্র : বিবিসি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

বাংলাদেশের চিন্ময় গ্রেফতারে ভারতের বিজেপি নেতার ‍উষ্মা, সীমান্ত অবরোধের ডাক

দখিনের সময় ডেস্ক: গুরুতর অভিযোএগ গ্রেফতার হয়েছেন বাংলাদেশের ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী। ‍এ ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার...

আওয়ামী ভুতে আক্রান্ত ওসি!

দখিনের সময় ডেস্ক: স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলে পুলিশের বাড়াবাড়ি চরমে পৌছেছিলো। এদের অনেকের কথাবার্তায় লাগাম ছিলো না। ‍এরা ছিলো আওয়ামী ভুতে আক্রান্ত। ৫ আগস্ট আওয়ামী...

মন খারাপের কথা শোনে ‘মাইন্ডি’

দখিনের সময় ডেস্ক: ‘মাইন্ডি’ নাম অনেকের কাছেই অপরিচিত হলেও, হাজারো তরুণের জন্য হতে পারে আশার আলো। তারা শুধু তরুণদের নিয়েই যে কাজ করেন এমনটি নয়।...

চিয়া সিড কি পেটের মেদ কমাতে পারে?

দখিনের সময় ডেস্ক: চিয়া সিড সুপারফুড হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে যারা পেটের মেদ ঝরাতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান তাদের জন্য এটি বেশ উপকারী হিসেবে...

Recent Comments