দখিনের সময় ডেস্ক:
‘আমি যা কিছু আছি এবং আমি যা কিছু থাকবো তার সব কিছুর জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী।’ গ্যারি পলস’র এই বিখ্যাত উক্তিটিই আসলে বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় ধারায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত বইগুলোর মধ্যে যেগুলো বস্তুনিষ্ঠ ও সুপাঠ্য তেমনই একটি বই মনসুরুল আলম মন্টু রচিত’ ‘বরিশাল মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে’।
এ বইটিতে ১৯৭১ সালের ৯ মাসের যুদ্ধের নানান ঘটনা এবং ঘটনার পিছনে ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি চিত্রিত করা হযেছে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা থেকে স্বাধিকার আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। ২০০৩ সালের জুন মাসে প্রকাশিত এই বইটি বর্ধিত কলেবরে দ্বিতীয় সংস্করন প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারী। এর প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন ডাঃ গাজী সুলতদান আহমেদ বাবু। বইটির মূল্য ৪শ’ টাকা।
দূর থেকে দেখা বা শুনে নয়, মনসুরুল আলম মন্টু বইটি রচনা করেছেন স্বাধীকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞ থেকে। যে কারণে তিনি লিখতে পেরেছেন, “বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো- উনসত্তরের মিছিলে আমাদের এ শ্লোগানে হঠাৎ করেই বরিশাল স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো। বরিশালের একজন কবি বলেছিলেন, মিছিল যেন আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা আর বোদ্ধা মানুষগুলো যেন হিম শীতল পাথর।” লেখক আরো লিখেছেন, “মিছিল শেষে মিছিলের উত্তেজনা নিয়ে আমরা এখানে ওখানে গেছি, আমাদের নেতাদের চোখে মুখেও দেখেছি আতঙ্কের ছায়া।…..কেউ কেউ আমাদের একান্তে ডেকে নিয়ে বললেন, নিজেরা তো বিপদ হাতে নিয়েছো, আমাদের জন্যও গর্ত খুঁড়ছো। কেউ কেউ বললেন, আত্মগোপনে যাও।”
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’-এই স্লোগানে মুখর ছিল ঊনসত্তরের মিছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের আলোকে স্বাধীনতার জন্য মানুষের একাগ্রতা, যুদ্ধে যাবার উৎসাহের জোয়ার সৃষ্টি হয় সারাদেশে। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্যপট! তখন সবাই ছিল স্বাধীনতাকামী। জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনসুরুল আলম মন্টু এই চিত্র দেখেছেন ভিতর থেকে। পাশাপাশি দৃশ্যপট পাল্টে যেতেও দেখেছেন তিনি।
ছাত্ররাজনীতি থেকে বেড়ে উঠেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আলম মন্টু। দেশের মানুষের দাবি আদায়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন তিনি। এ সময় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন একাধিকবার। রাজপথে তার মিছিলে গুলি হয়েছে। হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে বরিশাল রক্ষার অসম যুদ্ধে মৃত্যু দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ভারত যাবার পথে পড়েছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গানবোটের কবলে। সেবার ধরা পড়তে পড়তে সারেং-এর বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে গেলেও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়া থেকে আর বাঁচতে পারেননি। তবে সেবার প্রাণে বেঁচেছিলেন কৌশলে। এবং শুধু নিজের প্রাণ নয়, সতীর্থ সকলকে বাঁচিয়েছেন। কাবু করেছিলেন রাজাকার দলকে।
‘উত্তাল সেই দিনগুলোতে মনসুরুল আলম মন্টু ছিলেন বরিশালের প্রথম সারির ছাত্রনেতা। ঊনসত্তরে ছিলেন বরিশাল শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ’৭০ সালে হয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। পাকিস্তানের দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি, অংশ নিয়েছেন বরিশাল দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে। বরিশালের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার পর ভারত গেছেন অধিকতর প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে মুখোমুখি হয়েছেন নানান বৈরী পরিস্থিতির। নানান সংকট কাটিয়ে দেরাদুনে ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এরপর বিএলএফের গর্বিত সদস্য হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন মনসুরুল আলম মন্টু।
‘বরিশাল মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে’- গ্রন্থের লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আলম মন্টু মুজিব বাহিনীর সদস্য। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন দেরাদুনে। তিনি ৬ দফা আন্দোলনে সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ছিলেন বরিশাল শহর ছাত্ররীগের সাধারণ সম্পাদক। তখন আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তুঙ্গে। ১৯৭০-৭১ সালে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখনকার বরিশাল জেলা মানে আজকের বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা। ৭০-এর সাধারণে নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ৭১ সালে তিনি বলিশাল জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে ঐতিহাসিক দায়িদত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হন। পরে তিনি বরিশাল জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পদকের দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তাকে করা হয় বরিশাল জেলা আওয়ামী লগের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক। মনসুরুল আলম মন্টু পেশায় আইনজীবি। তিনি বরিশাল জেলা এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য। রাজনীতির দীর্ঘ পথগলায় গড়ে ওঠা মনসুরুল আলম মন্টু সময়ের পরিক্রমায় রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থান করছেন। তিনি জড়িত হয়েছে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে। ৩৫ বছরের প্রচেষ্টায় বরিশাল বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিষ্টিক বিদ্যালয় গড়ে তোলার অসাধ্য সাধন করেছেন মনসুরুল আম মন্টু।
হানাদারমুক্ত বরিশালে স্মৃতি হাতড়ে মনসুরুল আলম মন্টু তার বইতে লিখেছেন, “বরিশালের কীর্তনখোলার তীরে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়েছিলাম, কত বছর পর? হাজার বছর? সেই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের নির্মল হাওয়া এখন কোথায়?”