আলম রায়হান:
প্রচলিত প্রবচন, ‘নাপিতের ষোলচুঙ্গা বুদ্ধি’। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই প্রবচন বাস্তবে মহামারীসম প্রবনতা সৃষ্টি করেছে। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জনের কর্মকান্ডে। দৈনিক কালবেলায় ৩১ আগস্ট একটি সংবাদে জানাগেলো, নড়াইলের লোহাগড়ায় নিহত দলিল লেখকের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করে পুলিশ সুপার সমবেদনা জানিয়েছেন। এ রিপোর্টে একটি ছবিও ছাপা হয়েছে।
ছবিতে দেখে নিহতদের পরিবারের অসহায় পরিবারের সদস্যদের চেয়েও কারোকারো বেশি মায়া হয়েছে অসহায়ভাবে বসে থাকা পুলিশ সুপারের জন্য। একই সময়ে রাগও হয়েছে হয়তো কারোকারো। কারণ পুলিশ সুপারের কাজ কী কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে বিপন্ন মানুষগুলোকে শান্তনা দেয়া? তাতো নয়! পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে অপরাধীকে ধরা। এবং এ ক্ষেত্রে পুলিশ সুপার হচ্ছেন জেলার সর্বোচ্চ কর্তা। যেখানে ওসির ঠেলায়ই আগুন জ্বলে, সেখানে এসপি কেন কাঁদেন! অই একটা সিনেমা আছে না, ‘বাবা কেন চাকর।’ অবস্থা হয়তো সেরকমই।
দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত খবর, ‘নড়াইল পুলিশ সুপার মোসা. সাদিরা খাতুন নিহত বরকত আলীর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন।’ কেবল পুলিশ সুপার নন, তার সঙ্গে ছিলেন নড়াইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. দোলন মিয়া, লোহাগড়া থানার ওসি মো. নাসির উদ্দীন, ওসি তদন্ত আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ। এই প্রমুখের মধ্যে এসপি অফিসের অথবা থানার সুইপার ছিলেন কি-না তা অবশ্য কালবেলার রিপোর্টে উল্লেখ্য করা হয়নি। কিন্তু নিহত দলিল লেখকের স্বজনদের সঙ্গে এই সাক্ষাৎ যে একবারেই বেফজুল তা হয়তো অনুধাবন করতে পারেননি জেলা পুলিশ প্রধান। তবে কালবেলায় প্রকাশিত খবরে অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘এ সময় পরিবারের লোকজন পুলিশ সুপারের নিকট খুনীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।’
দাড়াচ্ছে এই, শুকনো কথায় যেমন চিড়া ভেজে না তেমনই মৌখিক শান্তনাকে মোটেই ধর্তব্যের মধ্যে নেননি ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলো। তবুও এই শান্তনারই অগ্রহণযোগ্য নিষ্ফলা ধারাই চলে আসছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই প্রবনতা কেন? এ ব্যাপারে একটি প্রবচন উল্লেখ করা যায়, ‘অকালে বর্ষাকাল, হরিনে চাটে বাঘের গাল।’ আসলে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় নানান ধরণের আকাল চলছে। ফলে এখন অনেকেই আর নিজের কাজটি করছেন না। অথবা করতে পারছেন না। কিন্তু কিছু কাজ তো দেখাতে হবে। অই প্রবচন আছে না, কাজ নেই তো খৈ ভাজ। অবশ্য এখন আর বাস্তবে খৈ ভাজার ধারা তেমন নেই। এই জন্যই হয়তো নাপিতে করে ডাক্তারের কাজ। অথবা ডাক্তারে নাপিতের কাজ করে।
এর সঙ্গে অবশ্য ২৬ আগস্ট বরিশালে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনায় প্রমানিত হয়েছে, ডাক্তাররা মাস্তানের কামও করে। তবে এটি ফেন্সিডিল আসক্তির প্রভাব, নাকি কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতার ফলশ্রুতি তা অবশ্য জানা যায়নি। এদিকে এই ডাক্তারদের বুদ্ধিমত্তায়ও কিন্তু নাপিতের কথা মনে পড়েছে অনেকেরই। ‘নাপিতের ষোল চুঙ্গা বুদ্ধি’ – হয়তো এই প্রবচনকেও ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন বরিশাল মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা। যে কারণে সাংবাদিক প্যাদানোর বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিতে আছেন সেই সহযোগী অধ্যাপক প্রবীর কুমার সাহা। যিনি নিজেই সাংবাদিক প্যাদানোর জন্য অভিযুক্ত।
নিশ্চয়ই কলেজ কর্তৃপক্ষের এই বুদ্ধিমত্তা নাপিতকেও হার মানিয়েছেন। অথবা সবাইকে নির্বোধ ঠাহর বরেছেন বা তারা নিজেরাই নির্বোধ। আবার এমনও হতে পারে, দেশের চিকিৎসক সমাজ আসলে নিয়ন্ত্রণহীন। এরা এমন এক জনগোষ্ঠী যারা নিয়ম-নীতি-নিয়ন্ত্রনের বাইরে। যাদেরকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন জেনারেল এরশাদ। যাকে প্রচলিত বাংলায় বলে, টাইট দেয়া। এটি অনেকেই জানেন। এদিকে অনেকেই না জানলেও কেউ কেউ জানেন, অন্যান্য ক্ষেত্রেও নাপিত আর ডাক্তার একাকার হয়েগেছে।
লেখন, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩