Home মতামত বরিশালে সাংবাদিকতার সেকাল-একাল

বরিশালে সাংবাদিকতার সেকাল-একাল

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে দুইজন সহযোগী অধ্যাপকের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণে গত ২৬ আগস্ট সাত সাংবাদিকের উপর হামলা এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে নানাবিধ নগ্নচিত্র স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং কতিপয় নেতার আপোষকামিতা সবাইকে ব্যথিত করেছে। অথচ বরিশালের অবস্থা এমনটা হবার কথা নয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য এই দৈন্যতার ধারক নয় মোটেই। বরং ঐতিহ্যগতভাবে বরিশাল অন্য এক উচ্চায় বলে বিবেচিত হতো।
শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-সাংবাদিকতায় বরিশাল অঞ্চল, মানে আজকের ৬ জেলা, অনেক সমৃদ্ধ ছিলো। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, বরিশালের পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছেন। গাফ্ফার চৌধুরী নিজেও লেখক-সাংবাদিক হওয়ার সূচনা বরিশাল থেকেই। বরিশালের পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে অনেকই সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, বরিশালে এবং ঢাকায়। এদিকে একাত্তরের রনাঙ্গন থেকে পত্রিকা প্রকাশের দৃষ্টান্ত আছে বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে। রণাঙ্গনের বিপ্লবী বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন অনেকে। সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্বে ছিলেন নূরুল আলম ফরিদ। নেপথ্যে ছিলেন জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ঘরানার এক দল তরুন শিক্ষক।
আর স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় বরিশাল থেকেই। সাপ্তাহিক গণডাক নামের এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আলম মন্টুর “বরিশার মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে” গ্রন্থর সূত্র মতে সাপ্তাহিক গণডাক পত্রিকার নেপথ্যে ছিলো আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। আর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন তাঁর স্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম। পত্রিকাটিতে কাজ করতেন সে সময়ের মেধাবী একদল তরুণ। এদের মধ্যে আবু আল সাইদ নান্টু, মনসুরুল আলম মন্টু, গাজী সুলতান আহমেদ বাবুসহ অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এদের মধ্যে আবার সদরুল ও নজরুল রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এদিকে সাপ্তাহিক গণডাক কেবল পত্রিকা ছিলো না, এটি ছিলো এক ধরনের মিলন কেন্দ্র। এই পত্রিকা অফিসে বসেই গঠিত হয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন খেয়ালী। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনসুরুল আলম মন্টু ও সাধারণ সম্পাদক আকবর হোসেন।
মুক্তিযুদ্ধ এবং শুদ্ধ রাজনীতির সুতিকাগার থেকে বরিশালে যে সাংবাদিকতার বিকাশ হয়েছে তার অধগতির সূচনা হয়েছে বছর পঁচিশ আগে। অধগতির এই বীজ রোপনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছেন বরিশাল রেঞ্জের প্রথম ডিআইজি। সেই বীজ থেকেই জন্ম নিয়েছে বিষবৃক্ষ। যা বরিশালের সাংবাদিকতাকে দুর্গতির দিকে নিয়ে গেছে। যে দুর্গতির পালে জোর হাওয়া লাগে সংবাদপত্রের মালিকানা থেকে হতাশ আথবা  ক্লান্ত হয়ে সৈয়দ দুলালের স্বেচ্ছা বিদায়। আর সাংবাদিক নেতৃত্ব হীনবল হতে শুরু করে লিটন বাশারের অকাল মৃত্যুর পর থেকে।
সেকাল-একালের ব্যবধান অনুধাবনের জন্য দুটি ঘটনা উল্লেখ্য করা যায়। অনেকেরই জানা, বরিশাল মেট্রেপলিটন পুলিশের একজন ‘সেই রকম’ কমিশনার ছিলেন  শামসুদ্দিন। তিনি এতোটাই দুর্নীতিবাজ ছিলেন যে, তার দাড়ি কামাবার ব্লেডও নাকী ওসিদেরকে কিনে দিতে হতো। তিনি কনেস্টবলদের সঙ্গেও ‘লেনদেন’ করতেন। শুধু তাই নয়, সোর্সমানির পুরোটাই তিনি একাই নিতেন। এ বিষয়ে রিপোর্ট হয় দৈনিক আজকের পরির্তনে। রিপোর্টার মিথুন সাহা। এ ঘটনায় পুলিশ কমিশনার শামসুদ্দিন খুবই চটে গেলেন। তার হাতে ডান্ডা আছে না! এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে সাংবাদিক  মিথুন সাহাকে দেখা করার জন্য হাইড্রোলিক প্রেসার দেয়া শুরু হয়। এই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন লিটন বাশারের কাজিন। প্রথমে আবদার-অনুনয়-বিনয়, পরে পুলিশী হুমকি-ধামকি। কিন্তু কোন কিছুতেই পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ দুলাল অথবা রিপোর্টার মিথুন সাহা একটুও টলেননি। এদিকে বরিশালে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষতক পুলিশ কমিশনারকেই রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে।
বরিশালে পুলিশ কমিশনার ছিলেন নির্লিপ্ত  গোছের । এই পুলিশ কমিশনারকে বিদ্রুপ করা বলা হতো ‘গরুর ডাক্তার’। যদিও তিনি গরুর ডাক্তার ছিলেন না। প্রেসক্লাবে অয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে  পুলিশে সাংবাদিকদের উপর লাঠিচার্জ করে। এতে লিটন বাশার আহত হন। এ ঘটনায় সাংবাদিকরা পুলিশ বিরোধী অবস্থান নেয়।  শুধু তাই নয়, তাকে আরো মূল্য দিতে হয়েছিলো। তাঁকে বরিশাল প্রেসক্লাবে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়।
এইরকম আরো অনেক ঘটনা আছে যা এখন কেবলই স্মৃতি। বরং তিনচার বছর আগে বরিশালে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক পুলিশ কমিশনারের মত বিনিময় অনুষ্ঠানে একজন মাননীয় সম্পাদক বিনয়ের অবতার হয়ে বলেছিলেন, “স্যার আপনার রুমে একটি লাঠি রাখবেন, আমরা কোন অপরাধ করলে আপনি আমাদের বিচার করবেন।” সম্পাদকের নমুনা যদি এমন হয় তাহলে আর কি কিছু বাকী থাকে! এ ব্যাপারে বরিশালের সাবেক ডিসি হাবিবুর রহমান একবার আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘এ কোন প্রাচ্যের ভেনিসে এলাম, মুরগীর ব্যাপারীও দেখি পত্রিকার মালিক হতে চায়!’ সকল মালিক অথবা সম্পাদক এমন, তা কিন্তু নয়। হয়তো গুটি কয়েক এ রকম। কিন্তু পারসেপশন ও পরিবেশ নষ্ট করতে বেশি লোকের প্রয়োজন হয় না।
দুর্দশা কেবল বরিশালে নয়। ঢাকা বা অন্য জেলাগুলোর অবস্থাও প্রায় তথৈবচ। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোথায় কতজন মালিক-সম্পাদক মানসম্পন্ন? কতজন সাংবাদিক নেতা সত্যের পক্ষে দাঁড়াবার সাহস রাখেন? কোথায় নিরাপদ সাংবাদিকরা! সর্বগ্রাসী এই দুর্দশা তো সাংবাদিকতায় ছিলো না। এতকিছুর মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে, কয়েকটি টেলিভিশন, কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে বরিশালে যারা কাজ করেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই সেরাদের সেরা হিসেবে পরিচত। বলা হয়, নিকস কালো আঁধারে এরাই হচ্ছেন আলোক বর্তিকা।
# ঢাকাটাইমস-এ প্রকাশিত, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেশনাল এমবিএ প্রোগ্রাম চালু

কাজী হাফিজ: বর্তমান বিশ্বে মাস্টার্স অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ) প্রোগ্রামকে ব্যবসা এবং ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কোর্স হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা...

গাড়িতে আসার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন রনোভাই

প্রায় দুই দশক আগে এসটিভি ইউএস নামে একটি টেলিভিশন আমেরিকা থেকে সম্প্রচারিত হতো। কিন্তু কার্যক্রম পরিচালিত হতো বাংলাদেশ থেকে। এতে মুখোমুখি নামে একটি টকশো...

মাছ ধরার সময় শ্বাসনালিতে বাইন মাছ

দখিনের সময় ডেস্ক: ঝুঁকিপূর্ণ দেখে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় শ্বাসনালি কেটে বাইন মাছটি বের করা হয়। এরপর রোগী সুস্থ হলে ৭-৮ দিন পর তার শ্বাসনালিতে বসানো...

অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে শিক্ষক পেটানো সেই ছাত্রলীগ নেতা বহিষ্কার

দখিনের সময় ডেস্ক: কলেজে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে শিক্ষক পেটানো ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। শিক্ষককে পেটানো বহিষ্কৃত এ ছাত্রলীগ নেতা হলেন মো. সাফাতুন নুর...

Recent Comments