বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের উচ্চারণ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। কবিতার ছলে বিশ্বকে শোনালেন মানবতার অমোঘ বাণী। সহস্র বছর ধরে যে মানুষের বসবাস, তাদের সংগ্রামী জীবনের উত্তরাধিকার আমরা। এ জীবন শান্তি ও সমন্বয়ের, শ্রম ও আনন্দের সংমিশ্রণ। এ চেতনাকে ধারণ করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাগিয়েছিলেন। এ ধারাবাহিকতায় অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। যা নানান মানদণ্ডে বিবেচিত হতো অসম্ভব বলে।
এ অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বলাবাহুল্য, এ অর্জনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের ওপর অনেকটাই ভরসা করেছেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রলীগ থেকে বেড়ে ওঠা নেতারা। কিন্তু বিরাজমান বাস্তবতায় বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসা ঘটনা প্রবাহে কবি বড়ু চণ্ডীদাসের উচ্চারণকে প্যারোডি করে কেউ কেউ বলেন, ‘সবার ওপর ছাত্রলীগ সত্য, তাহার ওপর নাই।’ প্রসঙ্গক্রমে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রলীগ শুধু সৃষ্টির নয়, ধ্বংসেরও ধারক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে যে খেলা হয়েছে তার কাঠখড় ছিল ছাত্রলীগের বৃহৎ অংশটি। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাকালে ছাত্রলীগের যে কেচ্ছাকাহিনি প্রকাশিত হয় তা তো আরেক ঘটনা। অনেকের বিবেচনায় যা সামরিক শাসকদের ছাত্র সংগঠনকেও হারা মানায়। সব মিলিয়ে ছাত্রলীগের গৌরবগাথা অনেকের বিবেচনায় এখন ‘ছেঁড়া কাঁথার’ মতো!
এদিকে সেই প্রবচন তো দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে, মাছের রাজা ইলিশ, চাকরির রাজা পুলিশ। তবে ইলিশ অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর পুলিশের ধরার মধ্যে সবাই। অনেক ক্ষেত্রে এ ধারা আবার বাঘের নখের চেয়েও ভয়ংকর। ‘সবার ওপরে ছাত্রলীগ’ এবং ‘চাকরির রাজা পুলিশ’—এক নারীকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বর এবং এ দুই শক্তি কেন্দ্রের ঘর্ষণে আগুন জ্বলার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, যা অনেককেই মনে করিয়ে দেয় হেলাল হাফিজের কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। এ কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে, অর্থলোভী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের হাতে বিশ্বের মানবতার বিপন্ন দশা, মারণাস্ত্রের নির্লজ্জ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ধনী দেশগুলো নৈতিকতা ও বিবেকবোধের অনুপস্থিতি। বলাবাহুল্য, এ দশা সর্বত্র বিরাজমান। তা হোক ঐতিহ্যের ছাত্রলীগ, অথবা কাগজপত্রের বর্ণনা অনুসারে জনগণের বন্ধু পুলিশ। এ দুই শক্তিকেন্দ্রের অনেক কেচ্ছাকাহিনি চাউর আছে। এর মধ্যে এমনসব ঘটনাও রয়েছে, যা ঘটার আগে থাকে অবিশ্বাস্য। এরপরও প্রতিকার হয়েছে, অথবা প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—এমনটা শোনা যায়নি। এমনকি তেমন প্রতিক্রিয়ার খবরও তেমন পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবার যেন উল্টো রথ। বেশ গর্জন হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনায়। তবে বর্ষণ হবে কি না তা বলা কঠিন। তবে এ দুই শক্তিরই ভেতরকার দগদগে ঘা প্রকাশিত হয়েছে।
এর সঙ্গে এডিসি হারুন-কাণ্ডে অনেক কিছু নগ্নভাবে সামনে চলে এসেছে। এমনকি এ নিয়ে আইজিপিকেও কথা বলতে হয়েছে। আর ডিএমপি কমিশনার তো সমানেই বলে যাচ্ছেন। ডিবিপ্রধান তো পিছিয়ে থাকার পাত্র নন। সবাই যেন বাচিক শিল্পী! অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়, পুলিশ কেন এত কথা বলে! গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে এডিসি হারুনের সঙ্গে শাহবাগের একটি হাসপাতালে পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিন আড্ডা দিচ্ছিলেন। যা ছিল অনেকটাই লটরপটর পর্যায়ের। কিছুক্ষণ পর সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে ওই নারী কর্মকর্তার স্বামী হাজির হন। তিনিও সরকারি কর্মকর্তা। যেনতেন নয়, খোদ রাষ্ট্রপতির এপিএস। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, হাতাহাতি-মারামারির একপর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে এডিসি হারুন কৌশলগত রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। কিছুক্ষণ পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের শাহবাগ থানায় নিয়ে মারধর করেন।
পুলিশের মারধরে আহত ছাত্রলীগের দুই নেতার একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে আহত ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন নাঈমের কয়েকটা দাঁত ভেঙে ফেলা হয়েছে। উল্লেখ্য, সামরিক শাসনামলে নির্যাতনের একটি পদ্ধতি ছিল, এক বা একাধিক দাঁত উপড়ে ফেলা। যে যন্ত্রণায় আমৃত্যু ভুগেছেন তরিকুল ইসলাম।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩