Home আন্তর্জাতিক ইরান ও পাকিস্তান উত্তেজনা কি যুদ্ধে মোড় নেবে?

ইরান ও পাকিস্তান উত্তেজনা কি যুদ্ধে মোড় নেবে?

দখিনের সময় ডেস্ক:
পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ ইরান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক। এই উত্তেজনা যুদ্ধে মোড় নিতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা গেছে। পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিক কিছু বিরোধ রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে ধর্ম। ইরান মূলত একটি শিয়া-পন্থী রাষ্ট্র। অন্যদিকে পাকিস্তান হচ্ছে সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিভিন্ন সময় শিয়া-সুন্নির উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে নানা হত্যাকাণ্ডও হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে ইরানের সম্পর্ক সবসময় একটা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে গেছে। যদিও ২০২১ সাল থেকে এই সম্পর্ক অনেকটাই স্থিতিশীল।
পাকিস্তানের ভেতরে ‘জঙ্গি গোষ্ঠীর ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে ইরান যেভাবে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে সেটিতে অনেকেই বেশ ‘বিস্মিত’ হয়েছেন। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, এই দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশকে আপাতদৃষ্টিতে থেকে পরস্পরের ‘ভ্রাতৃপ্রতিম ও বন্ধু’ বলেই মনে হয়। বিষয়টি আসলে পুরোপুরি সে রকমও নয়।সিস্তান-বেলুচিস্তান ইরানের একটি প্রদেশ। এর ঠিক পাশেই পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষে দিকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। যার একটি অংশ ইরানের অধীনে চলে যায়। ইরান মনে করে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে জঙ্গিরা এসে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে হামলা করছে। অন্য দিকে পাকিস্তানও মনে করে, বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন যোগাচ্ছে ইরানের গোয়েন্দারা। পাকিস্তান অংশে বালুচরা আলাদা একটি দেশ গঠন করতে চায়।
গত বছর ইরানের ভেতরে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা হয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে সর্বশেষ হামলায় ইরানের একটি পুলিশ স্টেশনে অতর্কিত আক্রমণে ইরানের ১১জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হয়েছে। ইরানের কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন, এসব হামলাকারীরা পাকিস্তানের ভেতর থেকে এসেছিল। একই ভাবে পাকিস্তানের ভেতরেও গত বছর দুটো আক্রমণ হয়েছিল যেখানে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। এই হামলার উৎপত্তিস্থল ইরানের ভেতরে ছিল বলে পাকিস্তান মনে করে। পাকিস্তান ও ইরান – দুদেশের সীমান্তের ভেতরে ‘জঙ্গিদের কার্যক্রম’ দেশ দুটির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে শিয়া-সুন্নি বিরোধ। পাকিস্তানে বিভিন্ন সময় শিয়াদের লক্ষ্য করে নানা ধরণের হামলা হয়। এ বিষয়টি ইরানের মধ্যে একটি চাপা ক্ষোভ তৈরি করেছে বহুদিন ধরে।
পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে মসজিদে যখন কোনও বোমা হামলা হয় তখন সেটি শিয়াদের বিরুদ্ধে হয়।কুয়ালালামপুরে মালয় ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও যুদ্ধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, নানাবিধ চাপের কারণে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক দৃশ্যত ভালো মনে হতো। কিন্তু ভেতরের পরিস্থিতি আসলে সে রকম নয়। তিনি বলেন, ইরান ও পাকিস্তান পরস্পরের মধ্যে একটা ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক’ বজায় রেখে চলেছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের ‘গোপন আস্তানা’ টার্গেট করে ইরান মিসাইল হামলা চালিয়েছে সিরিয়ার ইদলিবে এবং ইরাকের কুর্দিস্থানে। এছাড়াও লোহিত সাগরে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কিত জাহাজে হুথি বিদ্রোহীরা সেসব হামলা চালাচ্ছে তাতে ইরানের সংযোগ আছে বলে মনে করে পশ্চিমারা।
গত কয়েক বছর ধরে ইরানের বিরুদ্ধে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। ইরানের ভেতরে এবং বাইরে অনেক আক্রমণ হয়েছে। ইরানের শীর্ষ কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে যুক্তরাষ্ট্র হত্যা করেছে ইরাকের মাটিতে। অন্যদিকে ইরানের ভেতরে দেশটির শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী আহমেদ ফখরেজাদেকে হত্যা করা হয়েছে। এজন্য ইরান অভিযুক্ত করেছে ইসরায়েলকে। তাছাড়া পাকিস্তান সীমান্তেও ইরান-বিরোধী নানা তৎপরতা চলছে।মাহমুদ আলী বলেন, ‘ইরান একটা বার্তা দিতে চাচ্ছে। তারা তাদের সাধ্যমতো লড়াই করবে। ইরান রাষ্ট্রকে জনসাধারণের কাছে প্রমাণ করতে হবে যে তারা দেশের স্বার্থরক্ষা করতে পারে এবং তাদের সেই সামর্থ আছে।’
ইরানের পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে সংঘাত বাড়ানো ইরানের জন্য ঠিক হবে না। বিবিসি পার্সিয়ান ওয়েবসাইটে মোহাম্মদ ওয়াজিরি এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে নানাবিধ সমস্যা থাকলেও এদুটো দেশ পরষ্পরের ঘনিষ্ঠ। সেজন্য বুধবার ইরান যে হামলা চালিয়েছে সেটি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের যেমন সমস্যা ছিল, তেমনি ইরানেরও সমস্যা ছিল। ভারতের সাথে সীমান্তে পাকিস্তানের সমস্যা রয়েছে। অন্যদিকে ইরানেরও তাদের পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এসব কারণে পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তে বড় ধরণের উত্তেজনা তৈরি থেকে দুদেশের বিরত থাকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন মোহাম্মদ ওয়াজিরি।
পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সীমান্তে জঙ্গি-কার্যক্রমের যে সমস্যা আছে সেটি দুই দেশ একত্রে কাজ করে দূর করতে পারে। কোনও একটি পক্ষ থেকে একতরফা কাজ করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের যেন অবনতি না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলছেন পাকিস্তানের পর্যবেক্ষকরা। তারা মনে করেন, সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ইরানকে ভারতের কাতারে ফেলা ঠিক হবে না। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমাদ চৌধুরী জিও নিউজকে জানিয়েছেন, পাকিস্তান দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করেছে। জবাব দেবার মাধ্যমে পাকিস্তান প্রমাণ করেছে যে তারা এটা করতে চায় না, তবে চাইলে তারা করতে পারে। তিনি বলেন, ‘ভারত এবং আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত ভালো নয়। সেজন্য পাকিস্তানের উচিত হবেনা আরেকটি সীমান্তে বিবাদ তৈরি করা।’ তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি যাতে আরো খারাপের দিকে না যায় সেজন্য দুদেশের উচিত হবে পরিপক্কভাবে এই সমস্যার সমাধান করা।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান স্কলার মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, ইরানের হামলার বিপরীতে পাকিস্তান সমানভাবে জবাব দিয়েছে। পাকিস্তানের হামলায় শুধু জঙ্গি গোষ্ঠীকে টার্গেট করা হয়েছে, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীকে টার্গেট করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘এটা এখন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর রাস্তা খুলবে, যদি উভয় পক্ষ মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে। কিন্তু এখানে বড় একটা ‘যদি’ আছে।’’ পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে যা ঘটেছে সেটা এটা শক্তি প্রদর্শনের হামলা। কাউকে ধরাশায়ী করার জন্য নয়। এটা একটা রাজনৈতিক বার্তাও বটে।
উভয় দেশ পরস্পরের প্রতি তাদের সামর্থ দেখাতে চাইছে। পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পর ইরান যদি আবারো আক্রমণ করে তাহলে পাকিস্তান আরো জোরালো আক্রমণ করবে। সেক্ষেত্রে সংঘাত ছড়িয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেশনাল এমবিএ প্রোগ্রাম চালু

কাজী হাফিজ: বর্তমান বিশ্বে মাস্টার্স অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ) প্রোগ্রামকে ব্যবসা এবং ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কোর্স হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা...

গাড়িতে আসার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন রনোভাই

প্রায় দুই দশক আগে এসটিভি ইউএস নামে একটি টেলিভিশন আমেরিকা থেকে সম্প্রচারিত হতো। কিন্তু কার্যক্রম পরিচালিত হতো বাংলাদেশ থেকে। এতে মুখোমুখি নামে একটি টকশো...

মাছ ধরার সময় শ্বাসনালিতে বাইন মাছ

দখিনের সময় ডেস্ক: ঝুঁকিপূর্ণ দেখে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় শ্বাসনালি কেটে বাইন মাছটি বের করা হয়। এরপর রোগী সুস্থ হলে ৭-৮ দিন পর তার শ্বাসনালিতে বসানো...

অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে শিক্ষক পেটানো সেই ছাত্রলীগ নেতা বহিষ্কার

দখিনের সময় ডেস্ক: কলেজে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে শিক্ষক পেটানো ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। শিক্ষককে পেটানো বহিষ্কৃত এ ছাত্রলীগ নেতা হলেন মো. সাফাতুন নুর...

Recent Comments