দখিনের সময় ডেস্ক:
মানবিক মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর সব অপকর্মের অভিযোগ ওঠায় মিল্টন সমাদ্দারকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা, ৮৩৫টি লাশের কোনো হদিস না পাওয়া, আশ্রমে টর্চার সেলের সন্ধানসহ গা শিউরে ওঠার মতো আরও সব অপরাধের খবরে হতবাক পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান এই মিল্টন সমাদ্দারের সব রহস্য উদঘাটনে গোয়েন্দারা এখন মাঠে। মিল্টনকে গতকাল তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। এর আগে গত বুধবার রাতে রাজধানীর মিরপুর থেকে মিল্টনকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। রাতেই তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ। রাতের আঁধারে লাশ দাফন করতেন। সিটি করপোরেশনের মৃত্যুসনদও নিজেই তৈরি করতেন। এভাবে রাতের আঁধারে প্রায় ৯০০ লাশ দাফনের ভুয়া মৃত্যুসনদ নিজেই তৈরি করেছেন। এমন ভুয়া সিলসহ কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মিল্টন কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তার স্ত্রীকেও ডাকা হবে। কেউ যদি তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে তাহলে তাকেও গ্রেফতার করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, তার বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। তিনি তার বাবাকে পেটানোর কারণে এলাকাবাসী তাকে এলাকাছাড়া করে। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। তিনি বলেন, মিল্টন ঢাকায় এসে শাহবাগের একটি ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেন। সেখানে ওষুধ চুরি করে বিক্রির কারণে মিল্টনকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর একজন নার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ স্থাপনের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন।
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ আরও বলেন, মিল্টনের ২টা আশ্রম রয়েছে। সাভারের আশ্রমে ৫ থেকে ৭০০ লোক রয়েছে বলে মিল্টন জানিয়েছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ২০ থেকে ৩০ জনের বেশি লোক নেই। তার আশ্রমে যে অপারেশন থিয়েটার রয়েছে এর মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন কিনা তাও তদন্ত করা হবে। জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের কাছে মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে মিল্টন সমাদ্দারের নাম বেশ পরিচিত। মানবতার সেবক হিসেবে তার পাঁচটি ফেসবুক পেজে অনুসারী (ফলোয়ার) সংখ্যা প্রায় ২ কোটি।
মিল্টন সমাদ্দার গড়ে তুলেছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের বৃদ্ধাশ্রম। রাস্তা থেকে অসুস্থ কিংবা ভবঘুরেদের কুড়িয়ে আশ্রয় দেন। তাদের নিয়ে ভিডিও তৈরি করে প্রায়ই তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে দেখা যায়। মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরে তাদের জন্য বিত্তবানদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তার আবেদনে সাড়াও মেলে প্রচুর। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ১৬টির বেশি নম্বর এবং তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা জমা হয়। এর বাইরে অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অনুদান দিয়ে আসেন। মানবিক কাজের জন্য এখন পর্যন্ত তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন মিল্টন সমাদ্দার। কিন্তু এরপরই তার বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসতে থাকে ভয়ংকর সব অপরাধের তথ্য। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগগুলোর অন্যতম হলো, অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা। এমনকি তার পরিচালিত আশ্রমে তিনি যে কজনকে লালন-পালন করছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় তার চেয়ে কয়েক গুণ প্রচার করেন।
লাশ দাফন করার যে হিসাব মিল্টন সমাদ্দার নিয়মিত দিয়ে থাকেন, তাতেও বিরাট গরমিলের অভিযোগ রয়েছে। দাবি ৯০০ লাশ দাফনের, প্রমাণ মেলে ৬৫টির : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজে মিল্টন সমাদ্দার প্রায়ই দাবি করেন, তার আশ্রমে সব সময় ২৫০ থেকে ৩০০ অসুস্থ রোগী থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় যারা মারা যান, তাদের দাফন করেন মিল্টন। আবার তার আশ্রমে অবস্থানকালেও অনেকে মারা যান। মিল্টনের দাবি, সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ লাশ দাফন করেছেন তিনি। যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬০০ জন তার আশ্রমে মারা গেছেন। আর বাকি ৩০০ লাশ রাস্তা থেকে এনে তিনি দাফন করেছেন। এসব লাশ রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে দাবি তার।
অনুসন্ধানে মিল্টনের মিথ্যা তথ্য দেওয়ার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। জানা গেছে, মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে সব মিলিয়ে ৫০টি লাশ দাফন করা হয়েছে। এ ছাড়া রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১৫টির মতো লাশ দাফনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে আজিমপুর কবরস্থানে ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত কোনো লাশ দাফন হয়নি বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন সেখানকার দায়িত্বরতরা। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে মিল্টন সমাদ্দারের দাবি অনুযায়ী ৯০০ লাশ দাফন করা হলে বাকি ৮৩৫টি লাশ কোথায় গেল?
লাশ কাটা ছেঁড়ার দাগ : মিল্টন সমাদ্দারের দক্ষিণ পাইকপাড়া আশ্রমের কাছেই বায়তুর সালাম জামে মসজিদে এক সময় তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসা লাশ বিনামূল্যে গোসল করানো হতো। তার মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাকে এ সুবিধা দিয়েছিল। তবে গোসল করানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিটি লাশের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ শনাক্ত করেন। করোনার সময় এ বিষয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে প্রশ্ন করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরপর তিনি ওই মসজিদে লাশ পাঠানো বন্ধ করে দেন। পুলিশ এ বিষয়টিও তদন্ত করে দেখছে।
তিন দিনের রিমান্ড : মৃত ব্যক্তিদের জাল মৃত্যুসনদ দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে আসামিকে উপস্থিত করে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই কামাল হোসেন। অন্যদিকে রিমান্ড বাতিল ও আসামির জামিন চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আসামির জামিন নামঞ্জুর করে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন আদালত।