Home বরিশাল বরিশাল ল্যাবএইড-এর ভুল রিপোর্ট, বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ কর্তৃপক্ষের

বরিশাল ল্যাবএইড-এর ভুল রিপোর্ট, বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ কর্তৃপক্ষের

মামুনুর রশীদ নোমানী, অতিথি প্রতিবেক:
বরিশাল ল্যাবএইড-এর বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্ট দেবার অভিযোগ পুরনো। এবার কিডনী রোগের চিকিৎসায় রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষায় ভুল রিপোর্টকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। সূত্র বলছে, বরিশালে ল্যাবএইডের বিভিন্ন পরীক্ষায়ই প্রায়ই ভুল রিপোর্ট দেবার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষার ভুল রিপোর্টের কারণে অনেকের প্রাণ সংশয় হতে পারে। উল্লেখ্য, সঠিক চিকিৎসার প্রথম শর্তব হচ্ছে নির্ভুল পরীক্ষা।
গত ২৬ মে কলি (ছদ্ম নাম) ল্যাবএইডে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করলে রিপোর্ট দেখে ডাক্তারের সন্দেহ হলে কোন একটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করার কথা বলেন। রোগী চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে। ২৯ মে ঐ রোগী মেডিনোভা থেকে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করালে ফলাফল আসে শুন্য দশমিক ৯। আর ল্যাবএইডের পরীক্ষায় এসেছিল ২০৬। উল্লেখ্য, ক্রিয়েটিনিন টেস্ট দিয়ে চিকিৎসকরা বুঝতে চান রোগীর কিডনির অবস্থা কেমন। কিডনি ভালো থাকলে ক্রিয়েটিনিন লেভেল স্বাভাবিকের মধ্যে থাকে। অনেক বেশি হয়ে গেলে কিডনি ফেইলরের দিকে যেতে থাকে।
জানাজানি হলে  বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ। ভুল রিপোর্টের ব্যাপারে ল্যাবএইড বরিশালের ডিজিএম আব্দুল জলিল সিকদার বলেন, ‘ঐ রোগীর সাথে আমরা সমঝোতা করেছি।’ ভুল রিপোর্টের বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, যিনি ভুল রিপোর্ট দিয়েছেন তার ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে বরিশালের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার যদি এভাবে ভুল রিপোর্ট প্রদান করে তা দুঃখজনক। তিনি বিষয়টি খোজ খবর নিয়ে বৌবস্থা গ্রহনের আশ্বাস প্রদান করেন।
ক্রিয়েটিনিন কি?
ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষার ব্যাপারে কিডনী বিশেষজ্ঞ ডাঃ অপূর্ব চৌধুরী বলেন, শরীরে পেশির কাজ করতে শক্তির দরকার। এই শক্তির রাসায়নিক রূপ অঞচ। এই অঞচ জোগানোর একটি কেমিক্যাল ক্রিয়েটিনিন। ক্রিয়েটিনিন এক ধরনের এমাইনো এসিড। আমরা যখন মাংস খাই, তখন শরীরের মাসল, ব্রেইন, লিভার ক্রিয়েটিন সংগ্রহ করে মাংস থেকে এবং তা সঞ্চয় করে রাখে। যখন পেশিগুলোর অনেক বেশি পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে তখন ক্রিয়েটিনিন শক্তি সরবরাহে সাহায্য করে। রসায়ন প্রক্রিয়ায় শক্তি জোগাতে গিয়ে কিছু বর্জ্য তৈরি হয়। ক্রিয়েটিনিন থেকে তৈরি হওয়া এ বর্জ্যকে বলে ক্রিয়েটিনিন। শরীরে বা রক্তে কোনো বর্জ্য তৈরি হলে কিডনি সেগুলোকে প্রস্রাবের মধ্যে দিয়ে বের করে দেয়।
কিডনি হলো শরীরের ছাঁকনি। এখন সেই কিডনির ফিল্টার যদি ঠিকমতো কাজ না করে তখন শরীরের স্বাভাবিক পেশিগুলোর শক্তি জোগানের কাজে সহায় করা ক্রিয়েটিনিন থেকে উৎপাদিত বর্জ্য ক্রিয়েটিনিন শরীরে জমতে থাকে। তার মানে শরীরে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেশি বেড়ে গেলে বুঝতে হবে কিডনির ফিল্টার ঠিকমতো কাজ করছে না। পুরুষের শরীরে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক রেঞ্জ ০.৭ থেকে ১.৪ এবং নারীর ০.৬ থেকে ১.২ সম/ফখ। যখন এ মাত্রাটি ৬ থেকে ১০ সম/ফখ হয়ে যায়, বুঝতে হবে কিডনির ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
এ স্বাভাবিক রেঞ্জটি রক্তে ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করে বোঝা হয়। নাম : সিরাম ক্রিয়েটিনিন টেস্ট। এটি এ মাত্রায় থাকলে বুঝতে হবে হেলদি কিডনি। কিডনির স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তাই চিকিৎসকরা শরীরে কতটুকু ক্রিয়েটিনিন আছে, সেটা জানার চেষ্টা করে। শুধু কিডনির স্বাস্থ্য কেমন, এটি দেখতে রক্তে ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করা হয় না। চিকিৎসকরা কারও ওভারঅল স্বাস্থ্যের কন্ডিশন বুঝতে রুটিন পরীক্ষা হিসাবে রক্তের ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করেন। কারণ দেখা গেছে শরীরে কিছু ক্রনিক স্বাস্থ্য প্রবলেম, ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, হাই ব্লাড প্রেশার, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, এমনসব সমস্যা থাকলে রক্তে ক্রিয়েটিনিন লেভেল বেড়ে যায়।
আইনী বিধি বিধান
ভুল রিপোর্ট প্রদান করা মানে চিকিৎসায় অবহেলা। এব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিষ্টার সোলায়মান তুষার বলেন, চিকিৎসায় অবহেলা যাকে আইনি পরিভাষায় ‘মেডিকেল নেগলিজেন্স’ বা চিকিৎসায় অবহেলা বলতে মূলত চিকিৎসক ও রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত অন্য ব্যক্তিদের অবহেলাকেই বোঝায়। চিকিৎসায় অবহেলা শুধুই ‘অপারেশন’ বা অস্ত্রোপচারসংশ্লিষ্ট নয়।
রোগীকে সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা, রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, ফি নিয়ে দর-কষাকষি, ভুল ওষুধ দেওয়া, মৃত রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি রাখা, রোগীর ওপর জোর খাটানো, রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে অন্যত্র প্রেরণ করা, আইনি জটিলতার কথা ভেবে চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে ফেলে রাখা, হাসপাতালের শয্যা খালি না থাকার অজুহাতে চিকিৎসা না দেওয়া, স্বাস্থ্যগত বিষয়ে ভুল রিপোর্ট দেওয়া এগুলোও চিকিৎসা অবহেলার অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণসহ অনেক বিষয়ে ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজিস্ট্রেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’-এ নির্দেশনা রয়েছে।
আইনী প্রতিকার
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার উন্নয়ন সাধনকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনি কাঠামো এবং বাংলাদেশের আদালতের বিভিন্ন বিচারিক সিদ্ধান্তে এটি বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত যে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অধিকার মূলত জীবনের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং আইনগত প্রতিকারের জন্য বাংলাদেশে নির্দিষ্ট ও একক কোনো আইন কার্যকর নেই। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন আইনে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে আইনি প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে। সংবিধানের ১০২ অনু্চ্ছেদের আলোকে উচ্চ আদালতে রিট করারও সুযােগ রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক চাহিদার মধ্যে ‘স্বাস্থ্য’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৮ অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টিমান এবং ‘গণ-স্বাস্থ্য’ সুরক্ষার কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩২-এ বর্ণিত ‘জীবন রক্ষার অধিকার’ একটি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য। চিকিৎসায় অবহেলা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যর্থতা এই জীবন রক্ষার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। এছাড়া ১৮৬০ সালের প্রণীত দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারানুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি বেপরোয়া বা অবহেলামূলক কাজের মাধ্যমে কারও মৃত্যু ঘটায়, তাহলে সেটি ৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
দণ্ডবিধির ৩১২ থেকে ৩১৪ ধারায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া গর্ভপাত ঘটানো একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ২৭৪, ২৭৫ ও ২৭৬ ধারায় যথাক্রমে ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জামে ভেজাল মেশানো, ভেজাল ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি এবং এক ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম অন্য নামে বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। এসব অপরাধ দমন ও আইনি প্রতিকার প্রদানের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের মাধ্যমে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয় এবং শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে।
জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীর প্রাপ্য
১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১৯ ধারা অনুসারে কারও অবহেলাজনিত কাজের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি স্থানীয় দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি মামলা করতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুসারে কোনো রোগী ফির বিনিময়ে ডাক্তার, হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেবা গ্রহণ করলে তিনি ‘ভোক্তা’ হিসেবে গণ্য হবেন এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত অবহেলার শিকার হলে ভোক্তা অধিকার আইনে ক্ষতিপূরণ চেয়ে অভিযোগ করতে পারবেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার যদি রোগনির্ণয়ে ভুল বা অবহেলা করে, ফলে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা যদি সেবা প্রদানে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে, তাহলে ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করা যাবে। এই আইন অনুসারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাপ্য হবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

ডিভোর্সের দুদিন পরই সুখবর দিলেন এ আর রহমান

দখিনের সময় ডেস্ক: নিন্দুকরা মনে করছে বাংলার মেয়ে গিটার বাদক মোহিনী দে-র জন্যই হয়ত সায়রাকে ছেড়েছেন ভারতের অস্কারজয়ী সংগীতশিল্পী ও সুরকার এ আর রহমানের। তবে...

যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র টোকিও, সেক্স ইন্ডাস্ট্রির জড়িত কিছু চক্র

দখিনের সময় ডেস্ক: যখন স্বর্ণযুগ ছিল, শহরটি অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি দেখেছে। এটি এখনো বিশ্বের অন্যতম বাসযোগ্য শহর হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে আশঙ্কার বিষয়...

শীত নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

দখিনের সময় ডেস্ক: দেশের কোথাও কোথাও আকাশ আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। আবার কোথাও হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে বলে জানিয়েছে...

শেখ হাসিনা গুজব ছড়িয়ে দুর্বৃত্তদের উস্কানি দিচ্ছে: রিজভী

দখিনের সময় ডেস্ক: বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিদেশে বসে শেখ হাসিনা গুজব ছড়িয়ে দুর্বৃত্তদের উস্কানি দিচ্ছেন। ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্যই গত...

Recent Comments