Home বিশেষ প্রতিবেদন বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবনতা

বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবনতা

আলম রায়হান ও কাজী হাফিজুর রহমান:

ফেসবুক লাইভে এসে নিজের মাথায় গুলি করে বুধবার(৩ ফেব্রুয়ারী) রাত সোয়া ৯টার দিকে আত্মহত্যা করেছেন ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান (৫৮)। যিনি ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর। এ ঘটনায় আত্মহত্যার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। আত্ম হত্যা করছে নানান বয়স ও শ্রেনীর মানুষ।

পুলিশের পরিসংখ্যান মতে, জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত আত্মহত্যা করা ভিক্টিমদের মধ্যে ৫২ শতাংশ পুরুষ ও ৪৮ শতাংশ নারী। আত্মহত্যা করা এসব ভিক্টিমের ৬০ শতাংশই আত্মহত্যা করেছে গলায় ফাঁস দিয়ে। বিষপানে আত্মহত্যা করছে প্রায় ২৬ শতাংশ। গায়ে আগুন দিয়ে ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আত্মহত্যা করা এসব ব্যক্তির মধ্যে ২৫ শতাংশরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সী প্রায় ৩৮ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রায় ২২ শতাংশ এবং ১০ শতাংশের বয়স ৪৬ থেকে ৬০ বছর। ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক আছেন ৫ শতাংশ।

সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। আগে দেখা গেছে, একজন স্কুলছাত্রকে শিক্ষকরা স্কুলে বেদম মারধর করত। অভিভাবকরা মারধরের জন্য শিক্ষককে সাধুবাদ জানাতেন। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। এখন কোনো শিক্ষার্থীকে শিক্ষক মারধর করলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেন, অভিভাবকরাও ক্ষুব্ধ হন। এখন সমাজে আচরণের ধারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন আর বয়স কোনো আনুপাতিক বিষয় নয়। আমরা দিনে দিনে অনলাইন ও মোবাইল ফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি।

অনলাইনকেন্দ্রিক লাইফস্টাইল গড়ে উঠেছে। আগে একজন কিশোর কিশোরীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হতো। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনের ভয় ছিল। কিন্তু এখন প্রযুক্তির কারণে সহজেই একে অপরের সান্নিধ্যে চলে আসছে। আমাদের আবেগ, হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখগুলো সহজেই প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরের কাছে প্রকাশ করতে পারছি। এসব কারণে আবেগতাড়িত হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা বুঝতেও পারছেন না। আবার অনেক গেমস আছে যেগুলো আত্মহত্যার প্রবণতাকে উদ্বুদ্ধ করে। অনেকে লাশ ও রক্ত দেখলে ভয় পায় আবার অনেকে সেটা দেখে স্বাভাবিকভাবেই।

আমাদের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আগে দেখা গেছে; মানুষ লবণ দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে খুশি থাকত। কিন্তু এখন তারা চায় দামি জামা, জুতা, দামি মোবাইল ফোন। পণ্যকেন্দ্রিক আমাদের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো ক্লাসে তার বন্ধু দামি আইফোন বা দামি মোবাইল সেট নিয়ে আসছে। তখন অন্য বন্ধু যার হয়তো সামর্থ্য নেই তার মধ্যেও সেটি পাওয়ার আকাক্সক্ষা জাগে। মা বাবার কাছে চেয়ে না পেলে কেউ কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। প্রযুক্তি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারও আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ানোর জন্য দায়ী। এখন কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু আপলোড করলেই কেউ হয়তো না জেনেই আপত্তিকর কমেন্টস ও শেয়ার করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা উস্কে দেয়।

আত্মহত্যাপ্রবণ হওয়ার আগে তার আগে কিছু কর্মকান্ড আছে। যা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন শিশুটির মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আছে; সে আত্মহত্যা বা অন্য কোনো অপরাধ করতে পারে। তার মধ্যে বড় একটি বিষয় হচ্ছে আপনি যদি দেখেন, কোনো শিশু যদি অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করে যা সমাজ স্বীকৃত নয়; যেমন বেয়াদবি করা, মা বাবার কথা না শোনা, সে যাদের সঙ্গে মিশে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো না হওয়া, মা বাবার ওপর বিভিন্ন কারণে অতিমাত্রায় চাপ প্রয়োগ করা, তাহলে সে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। এমন আচরণ যা আমাদের সামাজিক প্রথায় মেনে নেয় না। আমরা এখন সন্তানদের স্কুলে শারীরিক শাস্তি দিতে পারি না। উচ্চ আদালতেরও এক্ষেত্রে নির্দেশনা রয়েছে। আমি নিজেও মনে করি শারীরিক মারধর উচিত নয়, এটি শিশুর সামাজিক মর্যাদা খর্ব করে। কিন্তু আমাদের সমাজে দ্রুত পরিবর্তনের কারণে মা-বাবা হিসেবে সন্তানদের যেভাবে অভিভাবকত্বসুলভ শাসন করা উচিত; আমরা সেভাবে শাসন করতে পারি না। মা-বাবার যে দায়িত্ব সেটা আমাদের অনেকের মধ্যে এখনো হয়তো গড়ে ওঠেনি। আমরা মা-বাবা হচ্ছি ঠিকই কিন্তু সন্তানকে যে ধরনের পারিবারিক অনুশাসন দেওয়া উচিত, সেটি দিতে পারছি না।

 কোনো শিশু-কিশোর যদি তার পারিবারিক প্রথা বা সামাজিক প্রথা যেগুলো রয়েছে সেগুলো ভঙ্গ করে, তাহলে তার পরিবারের উচিত তাকে বোঝানো যে, তুমি এটা করলে এটা পাবা না, এটা করলে ওটা হবে না, তুমি পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করেছ তুমি আগামী এক সপ্তাহ টিভি দেখতে পারবা না। শিশুকে শাসনের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সঠিক শাসন না করতে পারলে শিশু কিশোররা মনে করবে পাখি জামা পাওয়া তার অধিকার, আবার ২ লাখ টাকা দামের মোটরসাইকেল পাওয়া, কিংবা আইফোন বা ল্যাপটপ পাওয়াও অধিকার মনে করে। আর সে তার অধিকার না পেলে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। এ ছাড়া সামাজিক চাপ বেশি থাকলে, আয় ও সম্পদের বৈষম্য থাকলে তখনো আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে।

আত্মহত্যা প্রবণতা রোধে সন্তানকে তার অধিকার সম্পর্কে বোঝাতে হবে। তাকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। সন্তানকে বোঝাতে হবে অধিকার এবং দায়িত্ব একে অপরের পরিপূরক। শুধু তার অধিকার পেলেই হবে না তারও কিছু দায়দায়িত্ব আছে। কারণ আমরা শুধু সন্তানকে চাওয়া শিখাই, সন্তানের যে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব আছে সেটি বুঝতে শিখাই না। তাই আমাদের অভিভাবকদেরও দায়-দায়িত্ব নতুন করে শেখার বিষয় আছে। এই দায়িত্ব নিজেরা শিখতে পারলে সন্তানদের আত্মহত্যার মতো ভয়ানক অপরাধ প্রবণতা কমানো সম্ভব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

স্মার্টফোনে ইন্টারনেট চলে যাচ্ছে? জেনে নিন গতি বাড়ানোর কৌশল!

দখিনের সময় ডেস্ক: অনেকেই মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় হঠাৎ করেই দেখেন, নেটওয়ার্ক চলে গেছে। আশেপাশের অন্যরা নির্বিঘ্নে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারলেও আপনার ফোনেই সমস্যা...

প্রতিদিন ৩-৪ লিটার পানি পান করলে কী হয়?

দখিনের সময় ডেস্ক: ওজন কমানো একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ হতে পারে। কঠোর ডায়েট অনুসরণ করা, খাবারের প্রতি লোভ নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতিদিন জিমে যাওয়া, কঠোর ওয়ার্কআউট করা...

ডিভোর্সের দুদিন পরই সুখবর দিলেন এ আর রহমান

দখিনের সময় ডেস্ক: নিন্দুকরা মনে করছে বাংলার মেয়ে গিটার বাদক মোহিনী দে-র জন্যই হয়ত সায়রাকে ছেড়েছেন ভারতের অস্কারজয়ী সংগীতশিল্পী ও সুরকার এ আর রহমানের। তবে...

যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র টোকিও, সেক্স ইন্ডাস্ট্রির জড়িত কিছু চক্র

দখিনের সময় ডেস্ক: যখন স্বর্ণযুগ ছিল, শহরটি অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি দেখেছে। এটি এখনো বিশ্বের অন্যতম বাসযোগ্য শহর হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে আশঙ্কার বিষয়...

Recent Comments