বরিশাল দখল অভিযানে ঝুনাহারের প্রতিরোধ ভেঙ্গে দিয়ে সড়ক পথে শিকারপুরের কাছাকাছি পৌঁছে যায় পাকিস্তানী সৈন্যরা। তারা নৌকা দিয়ে নদী পার হবার চেষ্টা করে। এদিকে শিকারপুরে পাক বাহিনীকে পার করার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যে চাঁদপুর থেকে লঞ্চ আসে।
একই সময় হেলিকপ্টার থেকে ছত্রি সেনা নামানো হয় মহামায়া এলাকায়। এর পর তালতলি এবং কাঁশিপুর দিয়ে একই সময় শুরু করে গণহত্যা। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই পাখির মতো গুলি করেছে। আর হত্যার জন্য মানুষের কমতি ছিলো না। কারণ মানুষ ছুটছিলো উদভ্রান্তের মতো। যে যেদিকে পারে। কেউ ছুটছেন রাস্তা দিয়ে। কেউ রাস্তা ছাড়া, বেপথে।
চারদিকে কেবল ছুটন্ত মানুষ। কেউ গরু ছাগল নিয়েও ছুটছিলো। কারো সঙ্গে ছিলো হাড়ি-পাতিল-বিছানা। এমনকি বদনাও ছিলো কারো কারো সঙ্গে। আতংকে উদভ্রান্ত অবস্থা সবার। আর উদভ্রান্তের মতো ছোটা এই মানুষগুলোর প্রায় সকলেই শিকার হয়েছেন পাকবাহিনীর বুলেটের। এতে কারো মৃত্যু হয়েছে তাৎক্ষনিকভাবে। কেউ মরেছেন মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে। সে এক নারকীয় অবস্থা! খুব অল্পসংখ্যক মানুষই দৈবক্রমে পাকিস্তানী হত্যালীলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
এদিকে পাকবাহিনী গৌরনদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুক্ষীন হয়। এ সময় ১৬/১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপ্রত্যাশিত এই প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকবাহিনী অধিকতর সতর্ক হয়। সহজেই সকল প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে বরিশাল শহরে পাকিস্তান বাহিনী প্রবেশ করে সন্ধ্যা নাগাদ। তবে বীরদর্পে নয়, প্রবেশ করেছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে।
এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শী লিটু কর্মকার জানান, নতুন বাজার এলাকায় পাকিস্তান বাহিনী প্রায় ক্রলিং অবস্থায় থেকে আস্তেআস্তে এগিয়েছে। তারা একাধিক গ্রুপে প্রবেশ করেছে। একটি দল বাজার সংলগ্ন পুলিশফারী নিয়ন্ত্রণে নেয়। এখানে প্রতিরোধ হবে বলে খবর ছিলো পাক বাহিনীর কাছে। কিন্তু বাস্তবে কোন প্রতিরোধই হয়নি। ফাঁড়ির পুলিশ পিছনের খাল পেরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। দুই তিনজন ফাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তাদেরকে আটক করে পাক বাহিনী।
নতুন বাজার সড়ক ধরে এসে যে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাজারের কাছেই বগুড়া পুলিশ ফাড়ির নিয়ন্ত্রণে নেয়। এর পরই থানার পিছনে গণহত্যা চালিয়ে অন্তত ৭২ জনকে হত্যা করে। পরদিন তাদের লাশ হরিজন সম্প্রদায়ের লোক এনে ময়লার স্তুপে চাপা দেয়া হয়।
পুলিশফারির পিছনে কিলিং মিশনের পর একদল সৈন্য রহমতপুর গিয়ে বিমান বন্দর ধ্বংস করে দেয়। এদিকে আর্মি কাউনিয়া থানা, কোতয়ালী থানা ও বটতলা পুলিশফারী নিয়ন্ত্রণে নেয়। বরিশাল শহরের ভিতরে পাক বাহিনীকে কোন প্রতিরোধের সম্মুখিন হতে হয়নি।
পাকবাহিনীর অপোরেশনাল হেড কোর্য়াটার স্থাপিত হয় শহরের দক্ষিণ প্রান্তে ওয়াপদা কমপ্লেক্সে। আর কমান্ডিং অফিসারের অফিস কাম আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয় সার্কিট হাউজ। এক শ্রেণীর লোক সখ্যতা জমাতে থাকে হানাদার বাহিনীর অফিসারদের সাথে। কোন কোন পরিবারের মেয়েরা এদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ফলে সাধারণ সৈন্য যখন মাঠে হত্যা ও ধর্ষনে মত্ত তখন অফিসাররা সার্কিট হাউজে কৃষ্ণলীলায় বিভোর!
(আগামী কাল ১৯তম পর্ব)