Home লাইফস্টাইল আকস্মিক দুঃসংবাদ শুনলে কি কারও মৃত্যু হতে পারে?

আকস্মিক দুঃসংবাদ শুনলে কি কারও মৃত্যু হতে পারে?

দখিনের সময় ডেস্ক:

ফেসবুকে হরহামেশাই বরেণ্য অভিনেতা প্রবীর মিত্রের একটি মিম সামনে আসে। কোনো দুর্ঘটনা বা দুঃসংবাদ শোনার পর বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ছেন। অনেকে মজা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট লেখেন, এক জীবনে এতবার হার্ট অ্যাটাক আর কারও হয়েছে কি না, জানা নেই।

শুধু প্রবীর মিত্র না, নাটক, সিনেমায় প্রায়ই দেখা যায়, খুব কাছের কারও মৃত্যুসংবাদ বা আকস্মিক সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে নায়ক বা নায়িকার বাবা–মা বুক চেপে ধরে পড়ে গেলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাটক সিনেমায় তিনি মারা যান বা নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালের বিছানায়। ডাক্তার জানান, তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে কতটুকু সত্য? আসলেই কি তীব্র শোকের সংবাদ শোনার পর কারও মৃত্যু হতে পারে? কিংবা হতে পারে বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি?

কেন এমন হয়

হঠাৎ কোনো অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ জানার পর আমাদের যে প্রতিক্রিয়া হয়, সাধারণত সেটাকে বলা হয় ‘ইমোশনাল শক’ (মানসিক আঘাত)।

এ প্রসঙ্গে মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এনিমি ডারামুস বলেন, ‘অপ্রত্যাশিত ঘটনা আমাদের শরীর ও মনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে। শরীর ও মনের এই প্রতিক্রিয়াকেই বলে ইমোশনাল শক।’ খুব কাছের ভালোবাসার মানুষের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ, বড় ধরনের সম্পত্তি হঠাৎ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, নিজের বা প্রিয়জনের বড় ধরনের দুরারোগ্য রোগের খবর, দুর্যোগের খবর, বড় ধরনের অবমাননার মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা ইত্যাদি ইমোশনাল শক তৈরি করতে পারে। অপ্রত্যাশিত নেতিবাচক ঘটনা, যার জন্য ব্যক্তি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না, জানার পর তার মধ্যে ইমোশনাল শক হতে পারে। মনে সৃষ্টি হতে পারে তীব্র বেদনা। শরীরেও দেখা দিতে পারে যার প্রতিক্রিয়া। প্রথম বিষয়টি তিনি বিশ্বাস করতে চান না, এরপর হয়ে যেতে পারেন অনুভূতিহীন, তার মধ্যে তৈরি হতে পারে তীব্র রাগ আর ক্ষোভ। পরিচিত স্থান ও ব্যক্তিকে চিনতে পারেন না কখনো কখনো। শারীরিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে, হাত–পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, ঘাম হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরা, দাঁড়িয়ে থাকতে না–পারা, কথা বলতে না–পারা, দম বন্ধ হয়ে আসা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, গলায় চাপ বোধ হওয়া। মনে রাখতে হবে ইমোশনাল শকে সবার প্রতিক্রিয়া একধরনের হয় না, সব কটি লক্ষণ একসঙ্গে সবার মধ্যে থাকে না। এটি আসলে ব্যক্তির মনের গড়ন ও তার ব্যক্তিত্বের ধরনের ওপর নির্ভর করে।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

এ ধরনের আকস্মিক ইমোশনাল শকে কি কারও মৃত্যু হতে পারে? বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। প্রায় চার দশক আগে মার্কিন গবেষক জে এ এইচ ডেভিস ১৭০টি আকস্মিক মৃত্যুর ওপর গবেষণা করে জানিয়েছিলেন, সেখানে ২৭ শতাংশ মৃত্যুর সঙ্গে আকস্মিক মানসিক আঘাত বা অপ্রত্যাশিত নেতিবাচক ঘটনার সম্পর্ক আছে। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন–এ ২০০৫ সালে ড. ইলান ১৯টি এমন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তীব্র মানসিক আঘাত থেকে হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যাকে তিনি ‘ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক মৃত্যু না হলেও পরে দীর্ঘমেয়াদি হৃদ্‌রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিন্তু কোনো গবেষণাতেই খুব সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়নি যে মানসিক আঘাতই আকস্মিক মৃত্যুর একমাত্র কারণ।

সাধারণত অপ্রত্যাশিত খারাপ সংবাদ জানার পর আমাদের অ্যাকিউট স্ট্রেস হয়। সেই সময় নানা রকম শারীরিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। স্ট্রেসের সময় বেশ কিছু হরমোন নিঃসরণ ঘটে, যা হৃদ্‌যন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। সবার আবার সমান প্রতিক্রিয়াও ঘটে না। তাই আগে থেকেই যাঁরা শারীরিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ আর নাজুক অবস্থায় আছেন, যাঁদের আগে থেকে হার্টের সমস্যা বা অন্য কোনো ঝুঁকি রয়েছে, যাঁদের ব্যক্তিত্বের গড়ন নাজুক, তাঁদের জন্য এই মানসিক আঘাত (ইমোশনাল শক) বড় ধরনের সমস্যা, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। কিন্তু নাটক-সিনেমায় যতটা দেখে থাকি যে দুঃসংবাদ শোনামানেই বুক চেপে ধরে মৃত্যু, সেটা সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়।

কীভাবে বাড়াব ঘাতসহনশীলতা

তবে হ্যাঁ, মানসিক আঘাত মোকাবিলা করতে হবে। ইমোশনাল শকে যাতে নিজেকে ঠিক রাখা যায়, নিজের যাতে কম ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া হয়, সে জন্য নিজের ভেতরে ঘাতসহনশীলতা (রেজিলেন্স) বাড়াতে হবে। এ জন্য মনের যত্নের বিকল্প নেই। ইমোশনাল শক তৈরি হওয়ার আগেই যা যা করা যেতে পারে— সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। আপনাকে সমর্থন দেয় এমন বন্ধু আর স্বজনদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। ঘুমের সময় ঠিক রাখতে হবে। রাতে ঘুমাতে হবে। দিনে সক্রিয় থাকতে হবে। রাতজাগা নিষেধ।

খাদ্যাভ্যাস নিয়মমাফিক হতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। কোনো সমস্যা সামনে এলে এড়িয়ে যাবেন না। মোকাবিলা করার চেষ্টা করুন। সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত না থেকে নিজেকে কিছুটা সময় (মি টাইম) দিতে হবে। বিকল্প চিন্তার অভ্যাস করতে হবে। অন্যের চোখ দিয়ে যেকোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে। অবসরে সুস্থ বিনোদনের অভ্যাস করুন।

হঠাৎ দুঃসংবাদে কী করব: হঠাৎ করে যদি কোনো দুঃসংবাদের মুখোমুখি হয়েই যান, তবে তাৎক্ষণিকভাবে এটাকে মোকাবিলা করার জন্য যে বিষয়গুলো করা জরুরি— নিজেকে শান্ত হওয়ার সুযোগ দিন। বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গে থাকুন। তীব্র শোকে খাওয়া বন্ধ করবেন না। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। ধর্মীয় রীতিনীতি পালন শোককে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। মেডিটেশন, শ্বাসের ব্যায়াম, শিথিলায়ন মনের চাপ কমাতে সহায়ক।

এ সময় দৈনন্দিন ও পেশাগত কাজ ঠিকমতো করতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক; তাই কাজ থেকে সাময়িক বিরতি নিন। জোর করে কাজে ফেরার চেষ্টা করবেন না।

আগে থেকেই দীর্ঘমেয়াদি রোগ (হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, হাঁপানি ইত্যাদি) থাকলে লক্ষ রাখুন সেগুলো যেন সুনিয়ন্ত্রিত থাকে। নিয়মিত কোনো ওষুধ খেয়ে থাকলে খেয়াল রাখবেন, আপনার ওষুধ যেন বাদ না যায়। সুযোগ পেলে চিকিৎসকের পরামর্শে একটা রুটিন শারীরিক চেকআপ করিয়ে নিতে পারেন।

মনের ওপর চাপ যদি এত বেশি হয় যে আপনার চিন্তা, আবেগ আর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তাহলে অবশ্যই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

স্বজন বন্ধুদেরও দায়িত্ব আছে। এ সময় তাকে শুধু সান্ত্বনা দিলেই হবে না, পাশেও থাকতে হবে। সান্ত্বনা আর সমবেদনা অনেক সময় তাকে আরও বেশি করে দুর্বল করে। তাই সহানুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করুন। যেকোনো খারাপ সংবাদ কাউকে দেওয়ার আগে তার দেহ ও মনের অবস্থা বুঝে নিন। হুট করে কোনো খারাপ সংবাদ কাউকে দেবেন না। পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে তার সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ তৈরি করে তারপর দুঃসংবাদ জানান। তাকে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার সুযোগ দিন। তীব্র প্রতিক্রিয়া হলে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।

লেখা:আহমেদ হেলাল, মনোরোগ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

মানবাধিকার কর্মী মিনা ফারাহকে জামায়াত আমিরের ফোন

দখিনের সময় ডেস্ক: বিশিষ্ট কলামিস্ট, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী মিনা ফারাহকে ফোন করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। এ সময় তিনি বাংলাদেশের কঠিন...

পঞ্চগড়ে চা খামারিদের ক্ষমতায়নে ইউসিবির কর্মশালা

দখিনের সময় ডেস্ক: ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি (ইউসিবি) সম্প্রতি পঞ্চগড় জেলার চা খামারিদের জন্য একটি কর্মশালা আয়োজন করেছে। চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে আর্থিক...

সন্তানের অত্যাচারে শতবর্ষী বৃদ্ধের আত্মহত্যা

দখিনের সময় ডেস্ক: সৈয়দ আলী আকনে (১০৪) নামের এক শতবর্ষী বৃদ্ধের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে বিষপানে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। সৈয়দ আলী পিরোজপুরের ইন্দুরকানী...

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে কমিশন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: সিইসি

দখিনের সময় ডেস্ক: নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, নির্বাচন আয়োজন করতে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা দরকার। সবার সহযোগিতা...

Recent Comments