দখিনের সময় ডেস্ক:
মার্কিন মহাকাশ সংস্থার ‘মুন ফ্যাক্ট শিট’ অনুসারে, গত ৬০ বছরে ১০৯টি চন্দ্রাভিযানের মধ্যে মাত্র ৬১টি সফল হয়েছে, যা মাত্র ৬০ শতাংশ। আমেরিকা, রাশিয়ারও রয়েছে বহু ব্যর্থ চন্দ্রাভিযানের গল্প। কয়েকটি ব্যর্থ চন্দ্রাভিযান নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেনÑ আজহারুল ইসলাম অভি।
পাইওনিয়ার ২ : পাইওনিয়ার ২ ছিল চাঁদে মহাকাশযান পাঠানোর তৃতীয় চেষ্টা। কিন্তু এটির ভাগ্যও তার পূর্ববর্তীদের চেয়ে ভালো ছিল না। এটিকে বহনকারী রকেটটিতেও ৪২ মিনিটের মাথায় আগুন ধরে যায়। ফলে এবারও পৃথিবীর গ-ি পেরোতে পারে না মহাকাশযানটি। এ অভিযানটি নাসা পরিচালনা করলেও ভূমিতে থাকা পর্যন্ত এটি তত্ত্বাবধান করেছে আমেরিকান বিমানবাহিনী। উৎক্ষেপণের পর মহাকাশযানটি ১ হাজার ৫৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিল এবং এটি উৎক্ষেপণের পর কিছু ডেটাও পাঠিয়েছিল।
পাইওনিয়ার ২ সম্পর্কে কিছু তথ্য
যে দেশ পাঠিয়েছিল : আমেরিকা
চন্দ্রযান : এবল ৩, চন্দ্রযানের ওজন : ৮৭ পাউন্ড
মিশনের নকশা ও পরিচালনা : নাসা ও এএফবিএমডি
উৎক্ষেপণের তারিখ : ১৯৫৮ সালের ৮ নভেম্বর
উৎক্ষেপণ স্থান : কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি : আয়োনাইজেশন চেম্বার, ম্যাগনেটোমিটার, টেম্পারেচার সেন্সর, মাইক্রোমিটারয়েড সেন্সর, প্রোপোরশনার কাউন্টার টেলিস্কোপ ও টিভি সিস্টেম।
পাইওনিয়ার পি-৩ : সোভিয়েত ইউনিয়নের সফল মহাকাশযান উৎক্ষেপণের পর আমেরিকা প্রায় ক্ষিপ্ত হয়েই এই মহাকাশযানটি চাঁদে পাঠানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু এর ফল আগের মিশনগুলোর চেয়ে ভয়াবহ রকম খারাপ হয়। উৎক্ষেপণের কয়েক মুহূর্ত বাদেই এটি ধ্বংস হয়ে যায়। এ মহাকাশযানটির নকশা করেছিল স্পেস টেকনোলজি ল্যাবরেটরিজ। এ মিশনটি পরিচালনা করা হয় ১৯৫৯ সালের ২৬ নভেম্বর।
পাইওনিয়ার পি-৩ সম্পর্কে কিছু তথ্য
যে দেশ পাঠিয়েছিল : আমেরিকা
চন্দ্রযান : এবল ৪ বি, চন্দ্রযানের ওজন : ৩৭২ পাউন্ড
মিশনের নকশা ও পরিচালনা : নাসা ও আমেরিকান বিমানবাহিনী, উৎক্ষেপণের তারিখ : ১৯৫৯ সালের ২৬ নভেম্বর, উৎক্ষেপণ স্থান : কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি : হাই এনার্জি রেডিয়েশন কাউন্টার, লো এনার্জি রেডিয়েশন কাউন্টার, আয়োনাইজেশন চেম্বার, ফটো স্ক্যানিং ডিভাইস, মাইক্রোমিটারয়েড সেন্সর, আসপেক্ট ইন্ডিকেটর ও রেডিও রিসিভার।
পাইওনিয়ার ৩০ : এ মিশনটি পরিচালনা করা হয় ১৯৬০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। পাইওনিয়ার সিরিজের অন্যান্য মিশন অসফলগুলোর মতো এ মিশনটিও ব্যর্থ হয়। পর্যাপ্ত গতিতে পৌঁছতে না পারায় উৎক্ষেপণের ১৭ মিনিট পর মহাকাশযানটিতে আগুন ধরে যায় এবং পৃথিবীর কক্ষপথই অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয় মহাকাশযানটি।
পাইওনিয়ার ৩০ সম্পর্কে কিছু তথ্য
যে দেশ পাঠিয়েছিল : আমেরিকা
চন্দ্রযান : এবল ৫এ, চন্দ্রযানের ওজন : ৩৮৭ পাউন্ড
মিশনের নকশা ও পরিচালনা : নাসা ও আমেরিকান বিমানবাহিনী, উৎক্ষেপণের তারিখ : ১৯৬০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, উৎক্ষেপণ স্থান : কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন।
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি : হাই এনার্জি রেডিয়েশন কাউন্টার, লো এনার্জি রেডিয়েশন কাউন্টার, আয়োনাইজেশন চেম্বার, ম্যাগনেটোমিটার, মাইক্রোমিটারয়েড ডিটেক্টর সান স্ক্যানার ও প্লাজমা প্রোব।
রেঞ্জার ৩ : এটি ছিল নাসার চাঁদে মহাকাশযান অবতরণ করানোর প্রথম মিশন। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মহাকাশযানটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, এমনকি এটি লুনার অরবিটেও পৌঁছতে পারে না। ১৯৬২ সালের ২৬ জানুয়ারি মিশনটি পরিচালনা করা হয়েছিল।
রেঞ্জার ৩ সম্পর্কে কিছু তথ্য
যে দেশ পাঠিয়েছিল : আমেরিকা
চন্দ্রযান : পি৩৪
চন্দ্রযানের ওজন : ৭২৮ পাউন্ড
মিশনের নকশা ও পরিচালনা : নাসা ও জেপিএল
উৎক্ষেপণের তারিখ : ১৯৬০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর
উৎক্ষেপণ স্থান : কেপ কেনাভেরাল এফএলএ
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি : ভিডিকন টিভি ক্যামেরা, গামা রে স্পেক্টোমিটার, রাডার অল্টিমিটার ও সিংগেল এক্সিস সিসমোমিটার।
লুনা ৪ : লুনা ৪ চাঁদে অবতরণ করতে না পারলেও এটি চাঁদের খুব কাছে পৌঁছেছিল। শুধু তাই নয়, মহাকাশে রেডিয়েশনের নতুন তথ্যও দিয়েছিল চন্দ্রযানটি। লুনা ৪ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক উৎক্ষেপিত তৃতীয় মহাকাশযান। চাদের উপকূলে পৌঁছানোর পর মহাকাশযানটির জুপিটার-এম নামের এস্ট্রোনেভিগেশন সিস্টেমটিতে গোলযোগ দেখা দেয়, যার ফলে এটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে পারে না। তবে এটি যখন চাঁদের ৫ হাজার ৩০০ মাইল দূর দিয়ে চাঁদকে অতিক্রম করছিল, তখনো এটি মহাকাশের বেশ কিছু তথ্য পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের ২ এপ্রিল মহাকাশযানটি পাঠানো হয়েছিল।
ওয়াই ই ৬ (লুনা) : এ মহাকাশ যাত্রাটি ব্যর্থ হয় মহাকাশযানের যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে। মহাকাশযানটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ার দরুন এটিকে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে ছিটকে পড়তে হয়। এ মহাকাশযানটিও সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক পাঠানো হয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালের ২০ এপ্রিল মহাকাশযানটি পাঠানো হয়।
সার্ভেয়র ৪ : নাসার সার্ভেয়র ৪ ছিল মহাকাশযানের চতুর্থ সিরিজ। সার্ভেয়র ৪ একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। যার ফলে আর জানা যায়নি কী ঘটেছিল সার্ভেয়র ৪-এর ভাগ্যে। ১৯৬৭ সালের ১৪ জুলাই এটিকে পাঠানো হয়েছিল এবং ১৭ জুলাই এটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
অ্যাপোলো ১৩ : অ্যাপোলো ১৩ মিশনটি ছিল মূলত চাঁদের উঁচু স্থানের রহস্য উন্মোচন করানোর। মহাকাশযানটির ভেতরে একটি অক্সিজেন ট্যাংকার বিস্ফোরণের পর সেটি আর সম্ভব হয়নি। মহাকাশযানটিতে নভোচারী যারা ছিলেন, তারা পরে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন এবং নিরাপদে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অ্যাপোলো ১৩ সম্পর্কে কিছু তথ্য
যে দেশ পাঠিয়েছিল : আমেরিকা
চন্দ্রযান : কমান্ড অ্যান্ড সার্ভিস মডিউল : ওডিসেই, লুনার মডিউল : একিউআরিয়াস, নভোচারী : জেমস এ লভেল, জন জ্যাক সুইগার্ট ও ফ্রেড হাইস
চন্দ্রযানের ওজন : ৬৩ হাজার ৮১৩ পাউন্ড
মিশনের নকশা ও পরিচালনা : নাসা
উৎক্ষেপণের তারিখ : ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল
উৎক্ষেপণ স্থান : কেপ কেনাভেরাল ফ্লোরিডা
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি : ফটোগ্রাফিক স্টাডিজ, উইন্ডো মেটেওরোইডস ডিটেক্টর।
লুনা ১৮ : লুনা অরবিটের নমুনা সংগ্রহের জন্য পরিচালনা করা হয়েছিল লুনা ১৮ মিশনটি। কিন্তু লুনার উপরিপৃষ্ঠে অবতরণের সময় এটি বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এটির সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। ডেটাও ট্রান্সফার হচ্ছিল নিয়মিতভাবে। লুনা ১৮ উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর, নয় দিন পর অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর এটি বিধ্বস্ত হয়।
প্রথম চন্দ্রাভিযান পাইওনিয়ার জিরো
চাঁদে প্রথম মহাকাশযান পাঠানো হয় ১৯৫৮ সালের ১৭ আগস্ট। পৃথিবী থেকে চাঁদে কোনো মহাকাশযান পাঠানোর প্রথম চেষ্টা ছিল এটিই। প্রথম চন্দ্রাভিযানের মহাকাশযানটির নাম ছিল এবল ১। আমেরিকান বিমানবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবল ১ উৎক্ষেপণ করা হয়, কিন্তু সবশেষে অভিযানটি ব্যর্থ হয়। প্রথমে এটি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার উৎক্ষেপণের কথা থাকলেও পরে আমেরিকান বিমানবাহিনী এটিকে উৎক্ষেপণ করে। মহাকাশে আমেরিকার প্রথম স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রায় ছয় মাস পর এ অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল। কিন্তু উৎক্ষেপণের ৭৩ দশমিক ৬ সেকেন্ড পরই এবল ১ বহনকারী রকেটটি বিস্ফোরিত হয়। পরে এ মিশনটির নাম দেওয়া হয়েছিল পাইওনিয়ার জিরো।
প্রথম চন্দ্রাভিযানের কিছু তথ্য : যে দেশ প্রথম মহাকাশযান পাঠিয়েছিল : আমেরিকা
প্রথম মহাকাশযানের নাম : এবল ১ , মহাকাশযানটির ওজন : ৮৪ পাউন্ড বা ৩৮ কিলোগ্রাম, মিশনটির নকশা ও তত্ত্বাবধানে ছিল : অ্যাডভান্স রিসার্চ প্রোজেক্টস এজেন্সি ও আমেরিকান বিমানবাহিনী, উৎক্ষেপণ স্থান : কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন
ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি : ম্যাগনেটোমিটার, মাইক্রোমিটারয়েড ডিটেক্টর, দুটি টেম্পারেচার সেন্সর ও টিভি ক্যামেরা।
সম্প্রতি ব্যর্থ হওয়া ভারতের চন্দ্রযান-২
চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণ করা হয় গত ২২ জুলাই। এ রকেটের রয়েছে তিনটি অংশ। প্রথমটি একটি অরবিটার, দ্বিতীয়টি অবতরণ যান বিক্রম এবং তৃতীয়টি প্রজ্ঞান নামে ছয় চাকার একটি রোবটচালিত গাড়ি। এর লক্ষ্য ছিল চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করা। চন্দ্রযান-২ গত ২০ আগস্ট চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। শনিবার ভারতীয় সময় রাত ১টায় প্রায় ৩৫ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে এটি অবতরণ শুরু করে। মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইসরো এই ‘সফট ল্যান্ডিং’-এর দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারও করছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ২ দশমিক ১ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকার সময় মহাকাশযানের সঙ্গে ইসরোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বেতার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে গতকাল বিকেলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এক খবর থেকে জানা গেছে রবিবার দুপুরে অরবিটারের পাঠানো ছবি মারফত হারিয়ে যাওয়া বিক্রমের খোঁজ পাওয়া গেছে।