• ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘আইনের তোয়াক্কা না করে নিজের খুশিমতো কাজ করেছে পুলিশ’

দখিনের সময়
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩, ১৩:০৩ অপরাহ্ণ
‘আইনের তোয়াক্কা না করে নিজের খুশিমতো কাজ করেছে পুলিশ’
সংবাদটি শেয়ার করুন...
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে এডিসি হারুনের সঙ্গে শাহবাগের একটি হাসপাতালে পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিন আড্ডা দিচ্ছিলেন। যা ছিল অনেকটাই লটরপটর পর্যায়ের। কিছুক্ষণ পর সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে ওই নারী কর্মকর্তার স্বামী হাজির হন। তিনিও সরকারি কর্মকর্তা। যেনতেন নয়, খোদ রাষ্ট্রপতির এপিএস। এখানকার বিরোধই অেনেকটা লংকাকান্ডে রূপ নেয়।
ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে, কীইবা ঘটেছে তা নিয়ে দুপক্ষের বিপরীতমুখী বক্তব্য আছে। এর মধ্যে যে নারীকে নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড, তিনি ১২ সেপ্টেম্বর মুখ খুলেছেন। তার ভাষ্যমতে, দোষ তার স্বামীর। সত্য উদ্ঘাটন নিশ্চয়ই সময়সাপেক্ষ বিষয়। অথবা কখনো সত্য উদঘাটিত হবে না। হয়তো অন্য একটি ঘটনায় চাপা পড়ে যাবে। অথবা অন্য একটি ঘটনা ঘটিয়ে চাপা দেওয়া হবে। কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বরের দিনের ঘটনা চাপা দেওয়া সম্ভব হলেও যেসব প্রতিক্রিয়া এবং কথাবার্তা বলা হয়েছে, তা কি চাপা দেওয়া যাবে? এমনটা মনে হয় না। প্রথমেই ধরা যাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচ্চারণ। ছাত্রলীগের দুই নেতাকে বেধড়ক মারধরের ঘটনায় অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন-অর-রশীদ শাস্তি পাবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ১০ সেপ্টেম্বর এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এ পর্যন্ত খুবই সহিহ। এর সঙ্গে তিনি যখন যোগ করেন, ‘গতকালের ঘটনাটি প্রথম উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। কারণ, এডিসি হারুনের অনেক কাণ্ডের খবরই তো এর আগে একাধিকবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক ও ছাত্র থেকে শুরু করে নিজ বাহিনীর সদস্যকে লাঞ্ছিত ও নিপীড়নের ঘটনার খবর ভাইরাল হয়েছে, যা সবাই জানেন। কিন্তু আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না! কী মজা!
এদিকে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকও কথামালার ধারা থেকে দূরে থাকেননি। তিনি বলেছেন, এই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনাটি শুনেছি।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডিএমপি কমিশনার শুনবেন কেন? তিনি তো জানবেন! তার এত লটবহর আছে কোন কামে? অবশ্য অন্য এক কারণে হয়তো তিনি জানার ধারা থেকে একটু দূরে থেকে ‘শোনার ধারায়’ আছেন। তা না হলে তিনি নিশ্চয়ই জানতেন, এই এডিসি হারুন প্রসঙ্গ ডিএমপির সাবেক কমিশনার কী বলেছেন। বছরখানেক আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ২০ ডিএমপির তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলামও বলেছিলেন, এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে সময় ‘গুলি আছে কি না’ জানতে চেয়ে সহকর্মীকে এডিসি হারুনের থাপ্পড় মারার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এ ঘটনায়ও হারুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, এ ঘটনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘জানেন’ না। হয়তো জানেন না ডিএমপির বর্তমান কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকও। অথবা জেনেও চেপে গিয়ে অন্য কথা বলেছেন। আমজনতাকে বুদ্ধু মনে করলে যা হয় আর কি! অবশ্য এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেন, একমাত্র সন্তানের শিক্ষার ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার নাকি টেনশনে আছে। অবশ্য এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। তবে এটুকু জানা গেছে, ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার শফিকুল ইসলামও এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এতটাই ক্ষমতাধর এডিসি হারুন! হয়তো এ কারণেই তার বিষয়ে কথা বলার সময় দায়িত্ববানরা এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলী বয়ান উদগিরণ করেন। তা বিশ্বাসযোগ্য হোক বা নাইবা হোক। এ ধারায় সবচেয়ে মজার কথা বলেছেন গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেছেন, এডিসি হারুনের পরিবারের সবাই বিএনপি-জামায়াত সমর্থক। ১০ সেপ্টেম্বর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে এমনটা দাবি করেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। এতে হারুনের বাড়ি এবং মা-বাবার পরিচয়সহ লম্বা এক ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। শুধু চৌদ্দ গোষ্ঠীর কুষ্টিনামা দিতে বাকি রেখেছেন। তিনি এডিসি হারুনকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। গোলাম রাব্বানী আরও বলেছেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর জিয়া হলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী হিসেবে ছাত্রলীগ তকমা লাগান। কিন্তু তাকে কে প্রশ্ন করবে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
জানা কথা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডিএমপি কমিশনারসহ সরকারি লোকজন যা বলেছেন তা আসলে কৌশলী কথামালারই অংশ। তাদের এসব কথাবার্তা তেমন ধর্তব্যের বিষয় নয় বলে মনে করেন অনেকে। তবে এটি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন, এডিসি হারুন একদিনে বেপরোয়া হননি। আগের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হয়তো তিনি এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারতেন না। বেপরোয়া হতে হতে এবার যুক্ত হলেন নারীঘটিত ঘটনায়, যা কেন্দ্র করে ঘটল লঙ্কাকাণ্ড। আর এবার হারুনকে কিঞ্চিৎ বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। তাও কিন্তু নিজেদের গোলপোস্টে গোল দেওয়ার ঘটনায়। ছাত্রলীগ না হয়ে অন্য যে কেউ হলে, এ দশায় এডিসি হারুনকে পড়তে হতো না। যেমন অতীতে হয়নি। পুলিশ বলে কথা! যেমন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে সমবেত জনতার অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে সীমা লঙ্ঘন করেছেন সিংড়া থানার ওসি মিজানুর রহমান। কিন্তু তাকে কোনো জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হয়নি। বরং তার খুঁটির জোর প্রমাণিত হয়েছে। ওসির চেয়ে ডিএমপির এডিসি তো অনেক বড় বিষয়। অবশ্য ওসিদের ক্ষমতা নিয়ে নানান কাহিনি চাউর আছে।
অভিযোগ শুধু এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে নয়। বিভিন্ন মাত্রার অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধেই আছে। আর এর নেপথ্যের মূল কথাটি বলেছেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেছেন, ‘আইনের তোয়াক্কা না করে নিজের খুশিমতো কাজ করেছে পুলিশ।’ এ অবস্থা থেকে উঠে আসা জরুরি।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
# দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩