Home শীর্ষ খবর বেফজুল বদলি ইউএনও-ওসি

বেফজুল বদলি ইউএনও-ওসি

নির্বাচন কমিশনের অভিপ্রায় অনুসারে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশের উপজেলার ইউএনও এবং থানার ওসি গণবদলি মহাযজ্ঞ দেখল দেশবাসী। এটি হচ্ছে নির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বিতীয় চমক। প্রথম চমক হচ্ছে, নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতা-পাতি নেতাদের নির্বাচন করার সুযোগ করে দেওয়া। শুধু তাই নয়, উৎসাহও দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়ার অভিনব এ তরিকায় নানান ফজিলত আছে। একরকম নির্বাচনী থেরাপি। প্রধান উদ্দেশ্য, নির্বাচন জমজমাট করার দিকে নিয়ে যাওয়া এবং ভোটকেন্দ্রে অধিক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। এ উদ্যোগের ফল আখেরে প্রত্যাশার ফল কতটা পাকবে, তা নিয়ে নানান ধরনের বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েই গেছে। এরপরও এটি নিশ্চিত, বিএনপি না আসায় নির্বাচনকেন্দ্রিক এক ধরনের টুটাফাটা ফল প্রাপ্তি ঘটতে পারে। তা পাকুক আর নাইবা পাকুক; কিন্তু ইউএনও-ওসি গণবদলি এবং ‘কোনো ডিসির বিরুদ্ধে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে’ বদলির ঘোষণায় কী ফজিলত? এ কি মাকাল ফলের আশা!
এ প্রশ্নে উত্তর খোঁজার আগে একটি বিষয় কিঞ্চিৎ বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তা হচ্ছে, কাদের দিয়ে চলছে মাঠপ্রশাসন! এ ব্যাপারে কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা যাক। এক. গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. হাবিবুর রহমানকে ওএসডি করা হয়েছে ২২ অক্টোবর। কারণ এই গুণধর কর্মকর্তা বরগুনার ডিসি থাকাকালে এক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি বেডে লাল কভার বালিশে শুয়ে ডিসির সঙ্গে ফুলশয্যার খুনসুটি করছেন এক নারী। এ সময় ডিসির কাছে থেকে ৫০ হাজার টাকা দামের ফোন তিনি উপহার হিসেবে পাওয়ার কথা বলেন। ভিডিওতে রং-তামাশার ছলে ওই নারীর কপালে চুমু দেন ডিসি। পরে কিছুটা অন্ধকারে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ‘সেইসব’ অস্ফুট শব্দ শোনা যায়। বোঝা যায়, ওই নারী বরগুনা ডিসির বাংলোতে প্রায়ই রাত্রিযাপন করতেন। বরগুনায় আড়াই বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০২৩ সালের ৯ জুলাই তাকে উপসচিব পদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর উপসচিব পদ থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিও পেয়েছেন হাবিবুর রহমান। এরপর কামিনী কাণ্ডে পতন। দুই. বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহম্মদ বদলি হয়ে ঢাকায় পাট অধিদপ্তরে উপপরিচালক হিসেবে যোগদান করেছেন। বরিশালে থাকা অবস্থায় তার অনেক কেচ্ছা-কাহিনি চাউড় ছিল। ঢাকায় বদলি হওয়ার পর বরিশালে তার পদে দীর্ঘ সময় কেউ যোগদান না করার সুযোগ নিয়ে ব্যাকডেটে ঢাকায় বাণিজ্যের হাটবাজার বসিয়েছেন সৈয়দ ফারুক আহম্মদ। গুণধর এ কর্মকর্তার বিষয়ে সরকারের উচ্চমহলও অবগত আছে বলে মনে করা হয়। তবে তার বেশি কোনো ক্ষতি হয়নি। তিনি শুধু যুগ্ম সচিব হিসেবে প্রত্যাশিত পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। টাকার কুমিরের সামান্য ক্ষতি! তিন. জুমার নামাজের সময় কাতার সোজা করতে বলায় ইমামকে পানিতে চুবাতে চেয়েছেন কুমিল্লার লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফোরকান এলাহী অনুপম। ইউএনও ক্ষিপ্ত হয়ে রাগ ঝেড়ে বলেন, ‘আপনি কত বড় ইমাম হয়েছেন তা এখনই বুঝবেন। আপনাকে এখন পানিতে চুবাব। আপনার ইন্টারভিউ হবে, আপনি কীভাবে ইমাম হলেন তা জানব!’ এরপর নানান উদ্ভট প্রশ্ন করতে থাকেন। ১৩ অক্টোবরের এ ঘটনায় ‘শাস্তি’ হিসেবে তাকে রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় বদলি করা হয়েছে ২২ অক্টোবর। সিভিল প্রশাসনে উল্লিখিত বিষয় হচ্ছে, অসংখ্য ঘটনার মধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের কয়েকটি মাত্র। সাগরে এক ঘটি জলের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আর ওসি? তা তো মাশাআল্লাহ! তবে এদের ব্যাপারে খবর প্রকাশিত হয় কালেভদ্রে। কারণ এখন চলছে সেই প্রবচনের স্বর্ণযুগ, ‘মাছের রাজা ইলিশ, চাকরির রাজা পুলিশ!’ যে কারণে পুলিশের বিষয়ে খবর খুব একটা প্রকাশিত হয় না। এর মধ্যেই গুটিকয়েক খবরের মধ্যে ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘ওসির চাঁদাবাজি ১৯৬ কারখানায়’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসা করলে চাঁদা দিতে হবে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড শিল্প এলাকায় এ যেন নিয়ম। চাঁদাবাজির অভিযোগ পুলিশের সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে। সীতাকুণ্ড থেকে প্রতিমাসে প্রায় দেড় কোটি টাকা চাঁদা তেলা হয়।’ কিন্তু যেখানে শিল্পকারখানা অথবা চোরাই জ্বালানি বা পুরোনো লোহা বিক্রির কারবার নেই, সেখানের ওসিরা কী করেন? নিশ্চয়ই আল্লাহ-বিল্লাহ করে পরকালের চিন্তায় মগ্ন থাকেন না। বরং কী করেন তার বহু দৃষ্টান্ত আছে। এর একটি সাম্প্রতিক এক খুনের ঘটনায় দগদগে ঘা হয়ে প্রকাশ পেয়েছে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। ফরিদপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জহিরুল ইসলাম মামুন ওরফে হাতকাটা মামুন খুন হন ৫ ডিসেম্বর রাতে। ২০২২ সালেও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। গুণধর এই ইউপি সদস্য হাতকাটা মামুনের বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মাদক মামলা রয়েছে বাকেরগঞ্জ এবং বরিশাল সদর থানায়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে একাধিকবার। এমনকি বছরখানেক আগে ডিবিসি টেলিভিশনে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রচারিত হয়। সেই নিউজে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকারের বক্তব্যও প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি হাতকাটা মামুনের। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হাতে খুন হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি মুক্ত ও দাপটের মানুষ ছিলেন। কিন্তু নানান অপরাধ করেও মুক্তবিহঙ্গ থাকার রহস্য কী? নিশ্চয়ই অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। আসলে এই হাতকাটা মামুনদেরই রাজত্ব চলছে দেশে। তবে তাদের ট্যাক্স দিতে হয়। রসিদ ছাড়া, আলোচনায়, সমঝোতায়। দুপক্ষই খুশি। শুধু অখুশি আমজনতা। অবশ্য এতে কিছু আসে যায় না। আমজনতার আর দাম কী! এদিকে যে এলাকায় শিল্পকারখানা নেই, সেই এলাকায় ওসিদের আয়-ইনকাম কম হলেও একেবারে খরা—সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এই হাতকাটা মামুনরা কাদের হাতের কারসাজিতে খুন হওয়ার আগপর্যন্ত মুক্ত বাজপাখিসম ছিলেন? পুলিশের কী ভূমিকা ছিল?
আশঙ্কার খড়গ নামুক আর নাইবা নামুক, ইউএনও-ওসি গণবদলিতে কোনো ফলোদয় হবে না, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কারণ কোনোন শক্তি বা প্রাণীর লেজ সোজা করার কসরত কোনো কাজের কথা নয়। এজন্য নির্ধারণ করতে হয় মাথা। আর মাঠপ্রশাসনের মাথার তালিকায় আছেন বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার, ডিসি ও এসপি। মাঠপ্রশাসনে এরাই খেলোয়াড়; উকিল-মোক্তার। তা হোক ভালো অথবা মন্দ। নির্বাচন কমিশন এদের দিকে নজর না দিয়ে কী কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিষ্কারের মতো বিশাল আয়োজনের কাণ্ড করে বসল তা অনেকেরই মগজে ধরছে না। হতে পারে অন্যরকম বাস্তবতা আছে। যার কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত মেলে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠপ্রশাসন) মো. আমিন উল আহসানের উচ্চারণে। ইসি দেশের সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং থানার ওসিদের বদলির সিদ্ধান্তের পর অতিরিক্ত সচিব মো. আমিন উল আহসান বলেন, ‘যদি কোনো ডিসির বিরুদ্ধে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন, তাহলে তা নিয়ে আমরা ইসির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ডিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাইনি।’ ময়মনসিংহের ডিসিকে কেন প্রত্যাহার করা হয়েছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি না। এটি ইসি ও জনপ্রশাসনের সিদ্ধান্ত।’
সাধু! সাধু!! ডিসিদের বিষয়ে ‘সুনির্দিষ্ট’ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা। তাহলে ওসি-ইউএনওদের ব্যাপারে অন্য বিধান কেন? নাকি দেশের মানুষকে গাইতে হবে লালনের সেই গান, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/ নারীলোকের কি হয় বিধান। /সব লোকে কয়/ লালন কি জাত সংসারে/”। লালনের সুরের সঙ্গে কিছুটা সুর মিলিয়ে বিনয়ের সঙ্গে আমজনতা বলতে চায়, বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে আমাদের যারা শাসন এবং ‘ইত্যাদি’ করেন, তারা কি জাত আমাদের এই দেশে?
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
# দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত, ২০ ডিসেম্বর ২০২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

সরকার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: প্রধান উপদেষ্টা

দখিনের সময় ডেস্ক: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের...

গাজা-লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে  ৪৪ হাজার

দখিনের সময়  ডেস্কঃ গাজা-লেবাননে অব্যাহত রয়েছে ইসরায়েলি হামলা। বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় প্রাণ গেছে ৮৮ ফিলিস্তিনির। খবর...

রয়্যাল এনফিল্ডের বৈদ্যুতিক বাইক আসছে

দখিনের সময় ডেস্ক: বৈদ্যুতিক বাইকের বাজারে ইতোমধ্যেই পা রেখেছে রিভল্ট এবং ওলা। ওলার বাইক বাজারে না এলেও আকর্ষণীয় ডিজাইনের সঙ্গে কম জ্বালানি খরচ নজর কেড়েছে...

দুধের বিকল্প হিসেবে যা খেতে পারেন

দখিনের সময় ডেস্ক: উদ্ভিদ-ভিত্তিক দুধ বর্তমানে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। এটি বাদাম, ওট, নারিকেল বা মটরশুঁটি যাই হোক না কেন, দুধের এই বিকল্পগুলো স্বাস্থ্যকর ডায়েট...

Recent Comments