বলা হয়, সরকার পরিচালনা ও টিকে থাকতে আমলাদের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। উল্লেখ্য, আমলাদের ওপর রাজনৈতিক নির্ভরতার বিষয়টি সাধারণের কাছেও দৃশ্যমান হয়েছে ১৯৯৬ সালে। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চে’ যোগ দিয়ে অসংখ্য আমলা তৎকালীন খালেদা সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন। কোন দল ক্ষমতায় আসবে তা নির্ধারণে আমলারা প্রকাশ্যে জোটবদ্ধভাবে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন। এটি বাংলাদেশের প্রথম ঘটনা। এ ঘটনার পর আমলাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ছোটাছুটি করে এগিয়েছেন। পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও দক্ষতা।
বিরাজমান এ অবস্থা থেকে আমলাতন্ত্রের উত্তরণ কবে হবে কে জানে! তবে উত্তরণ অতি জরুরি। তা না হলে মৃদু ভূমিকম্পের মতো অশনিসংকেত আসতেই থাকবে। জানা কথা, বড় ভূমিকম্পের আগাম বার্তা দেয় একাধিক ছোট ভূমিকম্পন। তা আমলে নেওয়া হোক, অথবা নাইবা নেওয়া হোক। প্রসঙ্গক্রমে একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যাক। খেজুরের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে শব্দ প্রয়োগে বড় ধরনের বিভ্রাটের বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রি হয়েছে। উল্লিখিত চিঠিতে শব্দ প্রয়োগ কেলেঙ্কারি ঘটেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ বিষয়ে ১৪ মার্চ ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বিচক্ষণতারই পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এই ভুল কার, মন্ত্রীর না আমলার? অবশ্যই আমলার! নিশ্চয়ই প্রতিমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী উল্লিখিত চিঠি তৈরি করেননি। আমলাদের কেউ এ চিঠি তৈরি করেছেন। এরপর সচিবসহ আমলাদের কয়েক টেবিল ঘুরে প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে হয়তো।
উল্লেখ্য, যেসব মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী পরিচালনা করেন সেসব মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এ ছাড়া চলমান বাস্তবতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো সংবেদনশীল মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে এত বড় ‘কাঁচা ভুল’ কীভাবে হয়? আমলাকাণ্ডের আরেকটি বিষয় তো হাইকোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে। বেইলি রোডের রেস্তোরাঁয় রহস্যজনক আগুন লাগার ঘটনায় নগরজুড়ে অসংখ্য রেস্তোরাঁর শত শত কর্মচারীকে গ্রেপ্তার এবং ভাঙচুরের কাণ্ডটি নিশ্চয়ই রাজনীতিকদের নয়। এই তুঘলকি সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এ আশা ক্ষীণ। অথচ প্রয়োজন হচ্ছে, যে আমলারা খেজুরের দাম প্রসঙ্গে চিঠি তৈরি করেছেন ও রেস্তোরাঁয় ঢালাও অভিযানের সঙ্গে জড়িত এবং অনিয়ম থেকে সুবিধা নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। যাতে অন্যরা সাবধান হন। কিন্তু তা কি হবে? সম্ভবত হবে না।
এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে যাতে বিনা জবাবদিহিতায় আমলারা পার পেয়ে যান। তা হোক বৃদ্ধকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানো, তথ্য চাইতে যাওয়া সাংবাদিককে জেলহাজতে পাঠানো অথবা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে জনপ্রতিনিধির সঙ্গে প্রকারান্তরে যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করে বরিশালে ১০ প্লাটুন বিজিবি চাওয়ার ঘটনা। সামগ্রিক অবস্থায় অনেকেরই হয়তো মনে পড়বে সেই প্রবচন, ‘কুকুরে লেজ নাড়ে না, লেজে কুকুর নাড়ে!’ এদিকে লেজে কুকুর নাড়া এবং সুশাসনের ক্ষেত্রে বিরাজমান করুণ দশার জন্য চূড়ান্ত বিচারে দায়ী মূলত রাজনীতিকরাই। দায় সওয়ারের, ঘোড়া অথবা গাধার নয়!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত, ২২ মার্চ ২০২৪। শিরোনাম, “লেজে কুকুর নাড়ে!”