Home মতামত চাকরি কোনো মহান রিলিফ কর্ম নয়

চাকরি কোনো মহান রিলিফ কর্ম নয়

বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বিশ্ব যখন হিংসায় উন্মত্ত, রক্ত ঝরানো তাণ্ডবে দিশেহারা মানবকুল, সুন্দর পৃথিবী যখন নরকের প্রতিচ্ছবি; তখন বিশ্বকে বাংলার কবি শোনালেন মানবতার অমর এক কবিতা। কিন্তু এই কাব্যিক বাণীর কোনো প্রতিফলন নেই বিশ্ববাস্তবতায়। বরং এর উল্টোটাই চলে আসছে। তা হচ্ছে, সবার উপরে স্বার্থ সত্য, তাহার উপরে নাই। নিজের স্বার্থ, গোষ্ঠী স্বার্থ, মাফিয়া স্বার্থ। স্বার্থ হাসিলের তাণ্ডব চলে কখনো দেশের নামে, কখনো পণ্যের জন্য, কখনো আবার ধর্মের নামে। সবই হচ্ছে প্রাপ্তির উগ্র বাসনা। আর এ-ধারার সঙ্গে আমাদের দেশে অনেকটা দাঁড়িয়ে গেছে, ‘সবার উপরে চাকরি সত্য, তাহার উপরে নাই।’ আর চাকরি মানেই প্রধানত সরকারি! এই চাকরির মধ্যেও আবার আছে সরেস বিভাজন।
আসি যাই বেতন পাই,
কাজ করি ঘুষ পাই
বলা হয়, ‘মাছের রাজা ইলিশ আর চাকরির রাজা পুলিশ।’ অবশ্য সম্প্রতি সরকারি চাকরির বড় কর্তারা কিঞ্চিৎ হলেও দৌড়ের ওপর আছেন। বিশেষ করে পুলিশ। এর মধ্যেও বরিশাল চাকরি করে যাওয়া পুলিশের এক বড় কর্তা সম্প্রতি এমন এক পোস্টিং পেয়েছেন, যা অনেককে বিস্মিত করেছে। এই পোস্টিং পুলিশ বাহিনীতে চলমান অন্যরকম ধারার ইঙ্গিত দেয়। ব্যক্তি প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তো তোলাই যায়, চাকরি আসলে কী? সোজাসাপ্টাভাবে বলা হয়, চাকর থেকে চাকরি। তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কেষ্ট হোক, অথবা হোক আমাদের প্রভুর আসনে আসীন বিশাল ক্ষমতাধর ছোট-বড় আমলা-কামলাবৃন্দ। কিন্তু বাস্তবে এরা কেউ কেষ্ট নন। বরং উল্টো মূর্তি প্রকটভাবে বিরাজমান। চাকরি ধারায় চাকর তো অনেক দূরের বিষয়, সেবকও নন তারা। তারা এক-একজন মহাপ্রভু! আর ‍একবার চাকরি পাওয়া মানে আলাদিনের প্রদীপ হাতে পাওয়া। নিদেনপক্ষে নিশ্চিত জীবন। আসি যাই বেতন পাই, কাজ করি ঘুষ পাই। এই হচ্ছে সরকারি চাকরির প্রচলিত ধারার বিরাজমান সারকথা।
তাওয়া গরম হলে কেউ না
কেউ তো পরোটা ভাজবেই
অনেক সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি কোটায় আগ্রাসনে সরকার ব্যবস্থা যে ক্রমান্বয়ে হীনবল হয়েছে, তাতে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। এ অবস্থায় ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে চাকরিপ্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে পুনরায় মাঠে নামে। ছাত্রদের এ মাঠে নামাকে ছোট করে দেখা আসলে বাস্তবতা অস্বীকার করার নামান্তর ছিল এবং এখানেই বড় ছিদ্র সৃষ্টি হয়েছে। আর প্রচলিত কথা তো আছেই, সুচ খোঁজে ছিদ্র। এদিকে তাওয়া গরম হলো, অথবা নেপথ্য খেলায় গরম করা হয়েছে। আর তাওয়া গরম হলে কেউ না কেউ তো পরোটা ভাজবেই! বাস্তবেও হয়েছে তাই।
সরকারের অহমের কারণে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সারা দেশে অপশক্তি যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা ২০১৩-১৪ সালের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে একে কেন কর্তাশ্রেণি কেউ পাকিস্তানের বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করেন, তা বোধগম্য নয়। যেমন বোধগম্য নয়, কথায় কথায় আর ‘একটা মুক্তিযুদ্ধ করার আওয়াজ’। মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো দেশে মুক্তিযুদ্ধ একবারই হয়, এর মতো আর কিছু হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অতুলনীয়। আর কোনো কিছুই ’৭১ সালে পাকিস্তানি বর্বরতার মাত্রা ছাড়াবার মতো নয়। ’৭১ সালে পাকিস্তানি বর্বরতার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা করা হলে সেটা হবে নদী তীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে গরুর রচনা লেখার মতো।
সরকার ব্যবস্থায় পিঠে কুঁজ
হয়ে জেঁকে বসেছে
সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতার প্রশ্নটি তুঙ্গে ওঠা প্রসঙ্গে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে নানান বাস্তবতায় এবং বিভ্রমে চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরাটাই যেন মূল লক্ষ্য হয়ে গেছে। কিন্তু এটিকে মেধার ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না করে নানান কোটা আর ঘুষনির্ভর করে তোলা হয়েছে। এর সঙ্গে অধুনা বেরিয়ে এসেছে প্রশ্নপত্র ফাঁসে পাস করে চাকরি পাওয়ার বিষয়টি। এভাবে এমন একটি জনগোষ্ঠীর ওপর ভর করে সরকার কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে, যেটি আসলে যথেষ্ট মেধাসম্পন্ন নয়। এই দৈন্যদশার বোঝা ক্রমাগতভাবে সরকার ব্যবস্থায় পিঠে কুঁজ হয়ে জেঁকে বসেছে। এর সঙ্গে আছে নানা অনিয়মের ছোঁয়া, আছে সুদূরপ্রসারী আগ্রাসনও। আর চাকরিতে মেধাবী মানুষ আসার জন্য তো উপযুক্ত শিক্ষা চাই। কিন্তু সেই শিক্ষার হালহকিকত কী?
নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ভরপুর আমাদের শিক্ষা খাতে বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়, তার সিংহভাগই যায় ভবন নির্মাণ, উন্নয়ন ও হুজুরদের পকেটে। ফলে চারদিক ভবনে ভবনে ভরপুর। অথচ কোনোই সন্দেহ থাকার কথা নয়, শিক্ষার উন্নতি মানে শিক্ষার মানের উন্নতি। ফলে অবকাঠামোর চেয়েও মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত করা হচ্ছে মূল প্রয়োজন। সেটিই হচ্ছে না। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা একরকম পঙ্গু দশার মধ্যেই আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক-উচ্চ, সব ক্ষেত্রেই মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষকের অভাব প্রকট। আর উচ্চশিক্ষার শিক্ষকদের বেশিরভাগই তো উচ্চমানের সুযোগ সন্ধানী বলে পরিগণিত হচ্ছেন। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যারা জোড়াতালির দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হন, তাদের অর্ধেকের বেশিই হরেক কিসিমের কোটার নামে ছিল বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায়। যে নিগড় ভেঙে ঘোষিত মেধা কোটা ৯৩, কিন্তু বাস্তবে ঠেকবে ৯৮ শতাংশে।
চাকরি কোনো মহান
রিলিফ কর্ম নয়
প্রশ্ন উঠতেই পারে, স্বল্প মেধাবী, পিছিয়ে থাকা শ্রেণি এবং বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অসামান্য অবদান রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্নে কি কিছুই করার নেই রাষ্ট্রের? উত্তর, অবশ্যই আছে। তবে সেটি যোগ্যদের বঞ্চিত করে স্বল্পতর যোগ্যদের সরকারি চাকরি দেওয়া নয়। কারণ চাকরি কোনো দান-খয়রাত অথবা মহান রিলিফ কর্ম নয়। চাকরি হচ্ছে কাজের দায়িত্ব, যার বিনিময়ে রাষ্ট্র পারিশ্রমিক দেয়। যেমন ব্যক্তি মনিব দেয় চাকরকে। আর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মনিব হচ্ছে জনগণ। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। কাজেই তাদের ছেলে-মেয়ে-নাতি-পুতি, সবার প্রতি জাতির দায় আছে। থাকতেই হবে। কিন্তু এ দায় শোধ করার জন্য যোগ্যতার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে সরকারি চাকরি দেওয়ার ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হতে হবে কেন! এ বিধানে যোগ্য লোকের প্রতি অবিচার হয় শুধু নয় বরং একজন অযোগ্য লোক সরকার ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় নানা রকমের জটিলতা।
চাকরিতে কোটা প্রশ্নে আগে ‘কী করিলে কী হইতো’ সে প্রসঙ্গ এখন অবান্তর। চলমান পরিস্থিতিতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবার উচিত বিষয়টির গভীরতা অনুধাবন করা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত তিনটি পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্মস কমিশনই সুস্পষ্টভাবে বলেছে, কোটা একেবারে তুলে দেওয়া উচিত। কিন্তু এই মতামত হালে পানি পায়নি। প্রসঙ্গটি গেল সর্বোচ্চ আদালত ও রাজপথ। সেই আদিকাল থেকে সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে রাজপথ, যা এখনো চলছে; যা মোটেই ভালো কথা নয়। এটি রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের নিশ্চয়ই অনুধাবন করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। এ নিয়ে পানি বেশি ঘোলা হতে দেওয়া সুবিবেচনাপ্রসূত হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
আমেরিকা-চীন-ভারতের স্বার্থবলের
কেন্দ্রে বাংলাদেশ
বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, কোটার বিরুদ্ধে যেই বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী এবার রাস্তায় নেমেছিল, তাদের ভেতর অন্যরকম পুঞ্জীভূত ক্ষোভও কিন্তু আছে। আর এর ভেতরে-বাইরে অন্যরকম রাজনীতি ভর করেছে। এটি ক্ষমতাসীনদের গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। তা না করে বেশি জ্ঞানের কথা না বলাই বেহেতের। বোধগম্য কারণেই এ নিয়ে কোনো পক্ষের রাজনীতির খেলাকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ সবকিছুর মধ্যেই যেমন পানি থাকে, তেমনই জগৎ-সংসারের সব ঘটনার মধ্যেও রাজনীতি থাকে। এ রাজনীতি কখনো হয় সৃষ্টির, আবার কখনো হয় ধ্বংসের। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২১ জুলাই যুগান্তকারী রায় দিয়ে ধ্বংসের রাজনীতির রাশ অনেকটা টেনে দিয়েছেন। ফলে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুযোগে গোকুলে বেড়ে ওঠা ধ্বংসের রাজনীতির দানবের তান্ডব আপাতত থেমেছে। এবং এর লাগাম দৃশ্যত এখন সরকারের হাতে! তবে এই লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সাফল্য শুধু ক্ষমতাসীনদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে- এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। কারণ বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। এ বিষয়ে সরল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ স্পষ্টতই আমেরিকা-চীন-ভারতের স্বার্থবলের কেন্দ্রে আছে। বড় বিপদ এখানেই।
# দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত, ২৯ জুলাই ২০২৪। শিরোনাম, ‘ চাকরিটা আসলে কী’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক বুধবার

দখিনের সময় ডেস্ক: দেশের বাইরে, বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে যে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড....

ভারতে জনতার রোষানলে মন্ত্রী

দখিনের সময় ডেস্ক: ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুতে বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়েছেন সেখানকার একজন মন্ত্রী। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন সরকারি সহায়তা না...

আদালতে চিন্ময়ের পক্ষে ছিলেন না কোন আইনজীবী, জামিন শুনানি ২ জানুয়ারি

দখিনের সময় ডেস্ক: ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা ও সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন শুনানির জন্য আগামী বছরের ২ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন...

অন্তর্র্বতী সরকারের সাথে কাজ করতে চায় দিল্লি‍: ভারতীয় হাইকমিশনার

দখিনের সময় ডেস্ক: ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আটকে থাকার কোনও কারণ নেই। তিনি বলেন, আমাদের সম্পর্ক...

Recent Comments