অবশেষে বাস্তবতা উপলব্ধি করে বরিশালে পাক বাহিনীকে মোকাবিলার মতো সক্ষমতা অর্জন এবং অস্ত্রের জন্য ভারত যাবার ব্যাপারে সবাই একমত হলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো অন্য। টাকা! ভারত প্রতিবেশী দেশ হলেও তখনকার বাস্তবতায় বরিশাল থেকে ভারত মোটেই ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’ ছিলো না। সে সময়ের আলোকে সদলবলে ভারত যেতে বেশ অর্থের প্রয়োজন ছিলো। আর ভারত গেলেই তো হবে না, থাকা-খাওয়ারও চিন্তা করতে হয়েছে। আবার তখনকার রাজনৈতিক নেতা-ছাত্র নেতারা আজকের মতো ধনকুবের ছিলেন না।
এ ব্যাপারে মনসুরুল আলম মন্টু তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ভারত যেতে হলে আমাদের প্রচুর টাকা দরকার এটা কাউকে বলে দিতে হয়নি, আমরা নিজেরাও বুঝতে পারলাম। সুতরাং টাকা আছে কোথায় সে চিন্তা শুরু হলো।……..এই মধ্যে কেউ একজন এসে খবর দিলো, বেশ গোপন খবর, ভাটিখানায় আবগারী অফিসে অনেক টাকা আছে। ওদের ট্যাক্সের টাকা অথবা অন্যকোন খাতের টাকা। নানা ঝামেলায় ওরা ব্যাংকে টাকা জমা দিতে পারেনি। আমু ভাইকে জানালাম সঙ্গে সঙ্গে। আমু ভাই বললেন, আসলেই টাকা লাগবে, কেননা আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটা পরিবার আছে। তারাও অপেক্ষা করছে ভারত যাবে। আমাদের উপর ভরসা করে আছে। আমু ভাই একটা জ্বীপ নিলেন। জ্বীপ চালালো ইসমু। জ্বীপে আমি, মুশফিক, আরো দু’একজন। ভাটিখানা আবগারী অফিসে গিয়ে দেখি, অফিস খাঁ খাঁ করছে, কেউ কোথাও নেই। আমরা টাকার সন্ধানে হন্যে হয়ে এটাওটা সবকিছুই খুঁজলাম। টাকার কোন চিহ্ন নেই। হতাশ হয়ে ফিরছিলাম এ সময় কে একজন চিৎকার করে বলল, টাকা নয় বোধ হয় গাঁজা পেয়েছি। কাছে গিয়ে দেখলাম, সত্যি গাঁজা। মন ৩/৪ হবে। হঠাৎ কে যেন বললো, ওরে বাবা গাঁজা, অনেক দাম।’
এই গাঁজা পেয়ে সকলেই খুশি। ভাবনা এই- দেশে কতো গাঁজাখোর আছে, তাদের কাছে সেরমেপে বিক্রি করা যাবে। ফলে টাকার বদলে প্রাপ্ত গাঁজা বড় একটি বস্তায় ভরা হলো। পরে তা জ্বীপে তোলা হলো স্বর্নের মোহর বিবেচনা করে। এরপর এখানে ওখানে গাঁজার ক্রেতা খোঁজ করা হলো। কিন্তু একবারও ভাবা হয়নি, সেই ত্রাসের রাজত্বে গঞ্জিকাসেবী থাকলেও, অত গাঁজার ক্রেতা থাকার কথা নয়। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেও ক্রেতা মেলেনি। অগত্তা হতাশ হয়ে গাঁজা সংরক্ষনের সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু এই ‘গুপ্তধন’ রাখা নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। এ অবস্থায় মুশফিকুর রহমানের খালি বাসায় রাখার সিদ্ধান্ত হলো। যেই চিন্তা সেই কাজ। মুশফিকুর রহমানের বাসার মাচায় ঠেসেঠুস রাখা হলো গাঁজার বস্তা।
ভারত যাবার অর্থের সংস্থান করার জন্য এই গাঁজা আনা হলেও তা থেকে এক পয়সা আসেনি। কারণ যতই দামী হোক, তখনকার বাস্তবতায় গাঁজা কেনার খদ্দের পাবার কথা নয়। পাওয়া যায়ও নি। এদিকে গাঁজা রাখার কথা ভুলে গিয়েছিরেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও এই গাঁজার কারণে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে মুশফিকুর রহমান কবিরের বাবাকে। তবে শেষতক তিনি পাক আর্মির হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন ভাগ্যক্রমে। এটিই শান্তনা।