পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফরিদপুর দখল করে ২৪ এপ্রিল। সেখানে কিছুটা প্রতিরোধ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু এতে শহরটা দখল করতে হানাদার বাহিনীর তেমন বেগ পেতে হয়নি। কারণ ফরিদপরে যে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছে তা তা ছিলো কেবল চেতনা নির্ভর। যা সামরিক বাহিনী মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোনই কাজে আসার কথা নয়। আসেওনি। কারণ, অবেগ ও বাস্তবতা হাত ধরাধারী করে চলে না। বরং একে অপরকে গ্রাস করে। এ ক্ষেত্রে আবেগের পাবদা চলে যায় হাঙ্গরের গ্রাসে। এই বাস্তবতায় সহজেই ফরিদপুর দখল করে নেয় পাক হানাদার বাহিনী।
ফরিদপুর দখলের মুখে বহুলোক ফরিদপুর এলাকা থেকে বরিশালের দিকে আসছিলো। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছিলো নানান ধরনের খবর। এর মধ্যে ছিলো অনেক ধরনের আজগুবী কাহিনীও। কোন কোন বিষয়ে বর্ণনা ছিলো, অন্ধের হাতী দেখার মতো। কারো বয়ানীতে ছিলো প্রতিরোধের কল্পকাহিনী। কেউ বলছিলেন, তাসের ঘর খানখান হয়ে যাবার খবর। তবে এটা নিশ্চিত হয়েগেলো, এবার বরিশালের পালা।
তখন বরিশালে প্রবেশের সড়ক ছিলো মাত্র একটি। মাদারীপুর-গৌরনদী দিয়ে শিকারপুর-দোয়ারিকা-রহমতপুর-কাঁশিপুর হয়ে বরিশাল শহর। তবে সেই সময়ের সড়ক পথ আজকের মতো সহজ ছিলো না। এছাড়া শিকারপুর ও দোয়ারিকার ফেরী ছিলো। এ ফেরি দুটি আগেই ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো। ফলে হানাদার বাহিনীর জন্য একমাত্র সহজ ছিলো নৌ-পথ। এই নৌ-পথেই দখলদার এলো ঝুনাহার দিয়ে। জলদস্যুর মতো।
এদিকে এখানে সেই সময়ের বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি জোরালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিলো ঝুনাহার। অনেকগুলো বাংকার খনন করা হয়েছিলো। নেয়া হয় আরো অনেক ব্যবস্থা। সবমিলিয়ে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় ঝুনাহারে। এ প্রতিরোধ ভাংতে পাক বাহিনীকে গানবোট থেকে অসংখ্য গোলা বর্ষণ করা হয়। একই সময় গান বোটের গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দেয়া হয় নদীতে বেরিকেড হিসেবে ব্যবহার করা ইরানী ও মাজবী স্টিমার দুটি। এ সময় আরো কয়েকটি নোঙ্গর করা নৌ-যান ডুবিয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা মুখোমুখি হয় কঠিন এক বাস্তবতার।
বরিশালে ১৭ এপ্রিল বিমান হামলার ঘটনায় যে বাস্তবতার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে তা আবার ঘটলো ২৬ এপ্রিল হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে। সম্ভবত প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিকল্পনা করার সময় প্রতিপক্ষের সামরিক শক্তিকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে পেশাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো তা বড়জোর বিশাল ডাকাত বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত, কোন সেনাবাহিনীকে নয়।
এ কেবল পরিকল্পনার ত্রুটি নয়, সক্ষমতার ঘাটতি। তবুও লক্ষণ সেনের মতো পালিয়ে যাবার পরিবর্তে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর ফলে হানাদার বাহিনী এক ধরনের হোঁচট খেয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধা-জনতা সাহসে অধিকতর সমৃদ্ধ হয়েছে। যে সাহসের সূতিকাগার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ৭ মার্চের ভাষণে দিক নির্দেশনা। যার পুরোটা প্রতিফলিত হয়েছে বরিশালে প্রথম দিকেই।
বলা হয়, বরিশাল অভিযানে পাকিস্তান সেনা বাহিনী যে প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে তা শুরুর দিকে অন্য কোথাও হয়নি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভাংতে যেমন বেশ ঘাম ঝড়াতে হয়েছে, তেমনই তাড়াহুড়া করে শহরে ঢোকার সাহস পায়নি হানাদার পাক বাহিনী।