Home অন্যান্য নির্বাচিত খবর কোরবানির হাট টাকার গরম দেখানোর জায়গা নয়, সাক্ষাৎকার: কবি আসাদ চৌধুরী

কোরবানির হাট টাকার গরম দেখানোর জায়গা নয়, সাক্ষাৎকার: কবি আসাদ চৌধুরী

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মিজান শাজাহান (দৈনিক সমকাল থেকে)

প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও টিভি উপস্থাপক আসাদ চৌধুরী ‘কবি’ হিসেবেই সমধিক খ্যাত। ১৯৭৩ সালে শুরু করে ২০০০ সালে বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে যোগদান করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে। প্রায় ১০ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সাংবাদিকতা করেছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। ২০১৩ সালে তিনি পেয়েছেন একুশে পদক। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৮৭ সালে। আসাদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালে বরিশালে।

সমকাল: দেশের বাইরে এবার ঈদ করছেন। কেমন লাগছে?

আসাদ চৌধুরী : ১৯৯৬ সালের পর এবারই প্রথম স্ত্রী, ২ ছেলে, ২ বউমা, মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনিকে নিয়ে একসঙ্গে ঈদ করছি। এরকম একটি মিলনমেলার জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু আমার মধ্যে সেই আনন্দের বাতাস নেই। এর কারণ হতে পারে, মুমূর্ষু অবস্থায় দিন দশেক আগে সপ্তাহখানেক হাসপাতালে থাকার ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দেশে ঈদ করতে না পারার কারণেও হতে পারে।

সমকাল: কানাডায়ও কি বাংলাদেশের মতো ঈদ উৎসব হয়?

আসাদ চৌধুরী : বাংলাদেশের মতো গরু-ছাগল কিনে বাড়ির আঙিনায় কোরবানি করার রেওয়াজ বিদেশে নেই। এখানে কোরবানি মানে টাকা দিয়ে দোকান থেকে মাংসের ভাগ আনতে হয়। তবে সংখ্যায় অনেক বেশি না হলেও টরন্টোতে বাঙালি মুসলমান একেবারে কম নয়। এখানে ঈদের জামাতে মেয়র, সংসদ সদস্য, তারকারা আসেন। বিভিন্ন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হয়। বাঙালি কমিউনিটির পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। যথেষ্ট হেসে-খেলে ঈদ উদযাপিত হয়। আর ঈদের আনন্দ ঈদের দিনের চেয়ে চাঁদরাতে কেনাকাটা, মেয়েদের হাতে মেহেদি পরা বেশি পাওয়া যায়। কানাডায় আমার সবচেয়ে অপছন্দ- এখানে অনেক দামি জামাকাপড় কেনার হিড়িক পড়ে।

সমকাল: শৈশব-কৈশোরে ঈদের স্মৃতি মনে পড়ে?

আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁ। ওগুলোর তুলনা হয় না। চুল যত পাকে স্মৃতি তত বাড়ে। যত বয়স বাড়ছে ততই পুরোনো দিনের কথা বারবার মনে পড়ছে। বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জমিদারবাড়িতে আমার জন্ম। ঈদ এলেই ধোপা-নাপিতরা আমাদের বাড়িতে আসতেন। জামাকাপড় ধোয়ার উৎসব শুরু হয়ে যেত। গাফ্‌ফার ভাই (প্রয়াত আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী) এবং আমার চুল কাটতেন তাবুইন্না ও গৃহন্দু নাপিত। ক্ষেত্রমোহন ধুতি আমাদের জামাকাপড় ধুতেন। বিনিময়ে তাঁদের কাছ থেকে কোনো খাজনা আদায় করা হতো না। দিঘির পাড়ে স্থায়ী আবাসন করে দেওয়া হয়েছিল মুচিদের। তাঁরা কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে যেতেন। উলানিয়া জামে মসজিদে নাকাড়া বাজানো হতো। আমরা বলতাম নাগড়া। চামড়ার তৈরি অনেক বড় ঢোলের মতো। এটা হাতুড়ি দিয়ে পেটালে অনেক দূর থেকে আওয়াজ শোনা যেত। বিরাট ঘণ্টাও বাজানো হতো। জুমার নামাজের আজানের আগে নাগড়া ও ঘণ্টা বাজত। সেহরি-ইফতারে নাগড়া পেটানো হতো। ঈদের জামাতের আগেও বাজানো হতো। এসব এখন আর নেই। এখন বাজানো হয় সাইরেন।

সমকাল: গ্রাম-শহরের মধ্যে ঈদ কোথায় বেশি উপভোগ্য?

আসাদ চৌধুরী : গ্রামের একটা আলাদা মজা আছে; গ্রামলগ্ন বন্ধুবান্ধব। একটু নিরিবিলি সবুজ পরিবেশ। এই যে ঈদে লোকে বাড়ি যায়, এত কষ্ট করে! শুধু তো মা-বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার জন্য নয়; তাই না! বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, খালের পাশে বসা, নদীতীরে দাঁড়িয়ে মুক্ত বাতাস উপভোগ, পরিচিত গাছপালার কাছে ফিরে যাওয়া, নদীর টাটকা মাছ খাওয়া। খাঁটি দুধ-দই-মাখন খাওয়ার জন্যও অনেকে গ্রামে যায়। যেসব গ্রামে নদী নেই; সেখানে সবুজ পরিবেশ আর মুক্ত বাতাস তো অন্তত পায়। ওই গ্রামীণ জীবনই আমাকে টানত বেশি, যেটা ঢাকায় পেতাম না। গ্রামের রোজায় ইফতারি, চাল ও নারকেলের শরবত, হালুয়া আর কোথাও মিলবে না। দুঃখ হয়, টেলিভিশনে রান্নার এত অনুষ্ঠান দেখানো হয়, সেখানে সেই গ্রামের রান্না দেখি না।

সমকাল: বয়স বাড়ার সঙ্গে কি আনন্দে ভাটা পড়ে?

আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বার স্বাদ কমতে থাকে। গ্রামে ডিম ভাজলে অনেক দূর থেকে গন্ধ পেতাম। এখনও ডিম ভাজা হয়, তবে গন্ধ পাই না। ঘিয়ের গন্ধও আগের মতো পাই না। এটা হয়তো ভেজালের কারণে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের তৃষ্ণাও হ্রাস পায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শত্রুও বাড়ে। তবে আমার পুরোনো শত্রুদের সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগে। অতীত-কাতরতার স্বাদ পাই।

সমকাল: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার কোনটি বেশি আনন্দ দেয়?

আসাদ চৌধুরী : আমি সব রোজা রাখতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বেশিরভাগই পারিনি। এরপরও ঈদুল ফিতরই আমাকে বেশি টানে। হয়তো এই ঈদ ১০ মাস পর আসে বলে। আর ঈদুল আজহা তো ঈদুল ফিতরের দুই মাস পরই চলে আসে। তবে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদে আলাদা আনন্দ আছে। ঈদকে কেন্দ্র করে পশুর হাট বসে। খাসির জন্য কাঁঠাল পাতা সংগ্রহ, গরুর জন্য খড়কুটো সংগ্রহের পাশাপাশি গরুর গোসলের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর মাংস কাটার জন্য চাটাই সংগ্রহ, দা-বঁটি ধার দেওয়া, তেঁতুলের কাঠ সংগ্রহ। আসলে সব ঈদের আনন্দ আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়।

সমকাল: একাল আর সেকালের ঈদে তফাত কোথায়?

আসাদ চৌধুরী : অনেক তফাত। কালের বিবর্তনে ঈদকার্ড হারিয়ে গেছে; যদিও বিয়ে, জন্মদিনে এখনও কার্ডের প্রচলন রয়েছে। সেকালে আমরা হেঁটে হেঁটে আত্মীয়দের বাড়ি যেতাম। মুরব্বিদের পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। বিনিময়ে সালামিও পেতাম। ঈদের চাঁদ দেখার সংবাদ পেলে (ঈদুল ফিতর) এখন যেমন টেলিভিশন ও বেতারে কাজী নজরুল ইসলামের ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গান বেজে ওঠে; আমরা তখন মুরব্বিদের সালাম করা শুরু করতাম। এমনকি যে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগেও মুরব্বিদের পা ছুঁয়ে সালাম করার রেওয়াজ ছিল। এখন তা কেউ করে কিনা জানি না। সে সময় সুরমা-আতর কিনতাম। মেয়েরা হাতে মেহেদি পরত; তবে সেটা এখনকার মতো টিউবে থাকা বহুজাতিক কোম্পানির মেহেদি না। গাছ থেকে কাঁচা মেহেদি পাতা সংগ্রহ করে পাটায় বেটে তা হাতে পরত। এখন গ্রাম শহর হচ্ছে; সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। দুই মাস আগে আমি চার মাস বাংলাদেশে ছিলাম। তখন তিনবার আমাদের গ্রাম উলানিয়ায় গেছি। আগে সন্ধ্যায় লঞ্চে চড়লে পরদিন ভোরে গ্রামে পৌঁছতাম। সেখানে এখন ঢাকা-উলানিয়া রুটে দিনে-রাতে ৮টি লঞ্চ। অন্যদিকে পদ্মা সেতু হওয়ায় বরিশাল সদরসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় যাতায়াত আরও সহজ হয়েছে। বলতেই হয়- বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তবে এখনও ঈদের জামাতের পর কোলাকুলি হয়। প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কে গরিব কে ধনী সব পার্থক্য ধুয়ে-মুছে যায়।

সমকাল: কোরবানির মাধ্যমে আমরা কি মনের পশুত্ব কোরবানি করতে পারছি?

আসাদ চৌধুরী : চুল-দাড়ি পেকেছে। আমাকে তুমি করে বলার লোক খুব কম। বয়স বাড়লে এটাই লোকসান। কিন্তু এখনও প্রত্যাশা অনুযায়ী মানুষ তৈরি হতে দেখছি না। আমরা দিন দিন লোভী, স্বার্থপর, ভিতু ও প্রলুব্ধ হচ্ছি। সাড়ে ৭ লাখ টাকা দিয়ে কোরবানির গরু কিনে এক লোককে বাহাদুরি করতে দেখলাম সংবাদমাধ্যমে। এসব বাহাদুরি বন্ধ করেন। কোরবানির হাট টাকার গরম দেখানোর জায়গা নয়। কোরবানির ঈদে পশুর হাটে এসব লোকের বাহাদুরি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, টাকার গরম কাকে বলে! সর্বোচ্চ দামে পশু কেনার প্রতিযোগিতা বন্ধ করে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার শিক্ষা নিন।

সমকাল: মানুষের এই নৈতিক স্খলনের দায় কার?

আসাদ চৌধুরী : দায় অনেকেরই। তবে রাজনীতিবিদদেরই বেশি। ৪৫ বছর ধরে সমাজকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে আমলা ও বিভিন্ন বাহিনীর ওপর ভর করে টিকে থাকার প্রয়াস চালান। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লোক নেই বললেই চলে। তিতুমীর, দুদু মিয়া, হাজি শরীয়তউল্লাহর আন্দোলন অবিচার রুখে দিয়ে সমাজে সংস্কার এনেছিল। এখন রাজনীতিতে রাজনীতির চেয়ে দলবাজি বেশি। গ্রুপিং, সিন্ডিকেট, টাকার কাছে গণতন্ত্র নিরুপায়।

সমকাল: সমাজের এই পচন কি ঠেকানো যাবে?

আসাদ চৌধুরী :হ্যাঁ। নতুন প্রজন্মই পারবে এই কলুষিত সমাজব্যবস্থাকে বদলে দিতে। তারা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেবে। ওমুক ভাই তমুক ভাইয়ের নামে স্লোগান আর টেলিভিশন ও খবরের কাগজে সংবাদ হওয়ার রাজনীতি পরিহার করে জনগণের কাছে যেতে হবে। পরিবারেরও দায়িত্ব রয়েছে। যে পরিবারে মা-বাবা সন্তানকে নিয়ে ভালো গান শোনে; ভালো সিনেমা দেখে; সেই পরিবারের সন্তান এসব সংস্কৃতি শিখে বেড়ে উঠবে। আমি একটু বেশি আশা রাখছি- তরুণ প্রজন্ম অতীতের গ্লানি মুছে দেবেই। আমরা ঈদের দিন বই উপহার পেতাম। এখন সেই রেওয়াজ উঠে গেছে। পড়াশোনার বিকল্প নেই। বেঁচে থাকলে একটি প্রবন্ধ লিখব, ‘সন্তানের হাতে মোবাইল নয়, বই দিন’। কথাগুলো কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলিনি- এ কথা মনে রাখলে খুশি হবো।

সমকাল: সুদূর কানাডায় থেকেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। ঈদ মোবারক।

আসাদ চৌধুরী: প্রবাসে থাকার পরও সমকাল যে আমাকে মনে রেখেছে- এ জন্য কৃতজ্ঞতা। সমকাল পরিবারের সবাইকে ঈদ মোবারক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

নিজের চেয়ার ঠিক রাখতেই ব্যস্ত পুলিশ কর্মকর্তারা

দখিনের সময় ডেস্ক: জুলাই ২৪-এর আন্দোলনে গণহত্যার জন্য একক বাহিনী হিসেবে পুলিশকে দায়ী করা হয়। মানুষের ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে বাহিনীটির শতশত থানা, যানবাহন। জীবন গেছে...

সংস্কারের আগে নির্বাচন করলে কখনোই সংস্কার হবে না: তোফায়েল

দখিনের সময় ডেস্ক: সংস্কারের আগে নির্বাচন করলে আর কখনোই সংস্কার হবে না। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় এ মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন সদস্য...

না ভোট ফিরিয়ে আনার সুপারিশ সংস্কার কমিশনের

দখিনের সময় ডেস্ক: সরাসরি রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো প্রার্থী নির্বাচিত না হওয়া, না ভোট ফিরিয়ে আনা ও অর্থের উৎসের স্বচ্ছতা নিশ্চিতসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ...

সুযোগ পেলে গলা চেপে ধরবে আ.লীগ: রিজভী

দখিনের সময় ডেস্ক: গণহত্যার জন্য বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমা চাওয়ার কথা বললেও, সুযোগ পেলে আবারও তারা মানুষের গলা চেপে ধরবে। এমনটাই মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র...

Recent Comments