Home বিশেষ প্রতিবেদন ইতিহাসের নির্মম দুর্ভিক্ষ, প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ

ইতিহাসের নির্মম দুর্ভিক্ষ, প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ

দখিনের সময় ডেস্ক:
খাদ্যের অভাবে একটি দেশের জনসংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে কিংবা ২ মিলিয়ন লোক নিজ দেশ থেকে পালিয়ে গেছে, পথে পথে পড়ে আছে বুভুক্ষু মানুষের লাশ। এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল পৃথিবীর অনেক দেশকে৷ আফ্রিকা থেকে চীন কিংবা এই বাংলায় দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিহত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ।
বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম এই নির্মম দুর্ভিক্ষ  শুরু হয় ১৮৪৫ সালে ব্রিটিশ অধীনস্থ আয়ারল্যান্ডে। আইরিশদের প্রধান খাদ্য আলুর অপ্রাচুর্যতা থেকে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ৩৩ ভাগ আইরিশরা নিজেদের বাঁচার জন্য আলুর উপর নির্ভর করত। ক্যাথলিক নাগরিকরা ব্রিটিশদের দ্বারা নানাসময়ই অত্যাচারের শিকার  হত এবং নিজেরা চাষবাসের জন্য কোন জমি বর্গা পেত না। তার উপর হঠাৎ করে ফলন থমকে গেলে খাদ্যের অভাব দেখা দেয়।
মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয় যখন ব্রিটিশরা বাইরের  দেশ থেকে আসা খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। খাদ্যের অভাবে তখন দুর্ভিক্ষ চরম আকারে রূপ নেয়। আইরিশরা প্রাণ বাঁচার তাগিদে দেশান্তরী হয়। প্রায় ২ মিলিয়ন লোক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৮৫৩ সালে দুর্ভিক্ষ শেষ হলে দেখা যায় প্রায় দেড় মিলিয়ন লোক ক্ষুধার তাড়নায় মারা গেছে।
১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। আনাড়ি নেতৃত্ব এবং আগ্রাসী বন্যা এই দুর্ভিক্ষের পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৫ সালে টানা মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে কৃষিক্ষেতে বন্যা আঘাত হানে এবং প্রায় দেড় মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়৷ রাজনৈতিকভাবে দ্বিতীয় কিম জং মিলিটারি ফার্স্ট নীতি গ্রহণ করেন। ফলে সাধারণ জনগণকে রক্ষার চেয়ে সৈনিকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সরকার। নাজুক অর্থনীতির দেশটির খাদ্যশস্য আমদানি করার মত অর্থনৈতিক সক্ষমতাও ছিল না। যার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। দেশের সরকারের অবহেলায় ১৯৯৮ সালে দুর্ভিক্ষ শেষ হলে দেখা যায় প্রায় ৩ মিলিয়ন কোরিয়ান নিহত হয়েছে।
১৯০৭ সালে চীন এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচাইতে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের তালিকায় দ্বিতীয় সারিতে অবস্থান করা এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ২৫ মিলিয়ন লোক মারা যায়। পূর্ব ও মধ্য চীনে পাহাড়ি ঢল এবং বৃষ্টিতে এক প্রলয়ঙ্কারী বন্যা দেখা দেয়। ফলে দেশের প্রায় সকল কৃষিজাত শস্য বন্যার স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। ফলে খাদ্যসংকট চরমে পৌছে। ইতিহাসের নির্মম এই দুর্ভিক্ষে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজারের মত মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বা গ্রেট বেঙ্গল ফেমিন বাংলা তথা ভারতে ঘটা সর্বনাশা এক দুর্ভিক্ষ। ইতিহাসের অন্যতম করুণ এ দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় ১ কোটি মানুষ মারা যায়। বাংলা ১১৭৬ সালে এই দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয় বলে একে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে অভিহিত করা হয়। ইংরেজি ১৭৭০ সনের এই সময়টা ছিল চরম অর্থনৈতিক মন্দার বছর। তাছাড়া বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে কৃষকরা আশানুরূপ খাদ্য উৎপাদনে ব্যর্থ হয়। সীমিত খাদ্য যা থাকে তা নিয়ে নগ্ন ব্যবসায় মেতে উঠে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের জন্য খাদ্যশস্য লুকিয়ে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে।
ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে অবস্থার অবনতি ঘটে।কোম্পানি শাসকরা পুরো বিষয়টিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে দাবি করে। কিন্তু ভিন্ন সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, ১৭৬৮ সনে আদায়কৃত রাজস্ব ১৫.২১ মিলিয়ন রুপির চেয়ে ১৭৭১ সনের আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ৫,২২,০০০ রুপি বেশি ছিল, অথচ এর আগের বছরেই ঘটে যায় দুর্ভিক্ষ। কোম্পানি শাসনের সহযোগিতায়, খাদ্যশস্যের বাজার থেকে মুনাফা লুট এবং অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের কারণে সাধারণ জনগণের  ভোগান্তি চরমে পৌঁছে। পরিণতিতে মারাত্মক দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকাগুলি হয়ে পড়ে জনশূন্য।  জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর বাংলা আরেকটি মহাদুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। ১৯৪৩ সালের এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক অনাহারে মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান বার্মা দখল করে নিলে বাংলা অঞ্চলের কপালে দুর্দশা নেমে আসে। কেননা ভারতে চাল আমদানির একটা বড় উৎস ছিল বার্মা। ব্রিটিশরা নিজেদের সেনা এবং কর্মকর্তাদের জন্য চাল মজুদ করে রাখে।
তাদের মনে শংকা ছিল যে জাপান ভারত দখল করে নিতে পারে। তাই উদ্ভুত পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে তারা খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখে। ফলে হুহু করে বাড়তে থাকে চালের দাম। খাদ্যশস্য যাতে জাপানীদের হাতে চলে না যায় সেজন্য পুরো বাংলাজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়। বিশেষ করে নৌকা ও গরুর গাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়। ফলে বাংলায় চাল আসা আটকে যায়। ক্ষুধার্ত মানুষ অন্নের আশায় কলকাতার দিকে ছুটতে থাকে। ব্রিটেনের সরকারের অবহেলা আর গোয়ার্তুমির ফলাফল হিসেবে দুই বাংলায় প্রচুর মানুষ না খেয়ে পরপারে পাড়ি জমায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

এক যুগ পর আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনায় যাবেন খালেদা জিয়া

দখিনের সময় ডেস্ক: দীর্ঘ এক যুগ পর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলে আজ বৃহস্পতিবার...

সশস্ত্র বাহিনী দিবস আজ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বাণী

দখিনের সময় ডেস্ক: আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই দিনে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা প্রথমবারের মতো...

সাংবাদিক পরিচয়ে আপত্তিকর ভিডিও ধারণের অভিযোগ তিশার

দখিনের সময় ডেস্ক: শুটিংয়ে সাংবাদিক পরিচয়ে লুকিয়ে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করেছেন এক যুবক, বুধবার (২০ নভেম্বর) দিবাগত রাতে ফেসবুক লাইভে এসে এমনই অভিযোগ তুললেন অভিনেত্রী...

বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিলের নির্বাচনে বিএনপিপন্থিদের ধস

দখিনের সময় ডেস্ক: বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে আওয়ামীপন্থি নীল দল। সভাপতি, সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পদেই বিজয়ী হয়েছেন...

Recent Comments