দখিনের সময় ডেস্ক:
আমাদের এই ভুখন্ডে বিগত কয়েকশ বছরের মাঝে একাধিকবার দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহাস্থানগড়ের শিলালিপিতে এই অঞ্চলে প্রথম দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েক শতাব্দিতে আর কখনও দুর্ভিক্ষের তথ্য পাওয়া যায় নি। কিন্তু ধরে নেয়া হয় প্রায়শই এই অঞ্চলের মানুষ দুর্ভিক্ষতুল্য দারিদ্রের মাঝেই বাস করত। বড় কোন দুর্ভিক্ষের তথ্য যদিও অজানা।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
বাংলা ১১৭৬ সন, ইংরেজি ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ। তখন ছিল চরম অর্থনৈতিক মন্দা। অত্যাধিক বৃষ্টিপাত এবং বন্যায় কৃষক সেবার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। এর উপর রাজস্ব ব্যবস্থা এবং খাদ্যবাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্তের ফলে সাধারণ মানুষের অবস্থা চরমে পৌছে। ব্রিটিশ শাসকেরা পুরো ব্যাপারটিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে দাবি করে। বিভিন্ন সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ১৭৬৮ সালে রাজস্ব আদায় হয় ১৫.২১ মিলিয়ন রুপি এবং ১৭৭১ সনের আদায়কৃত রাজস্ব ছিল ১৭৬৮ সনের চেয়ে ৫২২,০০০ রুপি বেশি। অর্থাৎ, ব্রিটিশ শাসকেরা এবং তাদের দোসররা দুর্ভিক্ষের বছরও রাজস্ব আদায়ে কোন ছাড় দেয়নি। এই দুর্ভিক্ষে মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ মানে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
১৮৯৬-১৮৯৮ এর দুর্ভিক্ষ
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা যায় তবে প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল উড়িষ্যা। এসময় দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলগুলোতে কৃষিশ্রমিকদের মজুরি কমে যায়। সেবারই প্রথমবারের মতো দুর্ভিক্ষের কারণ খতিয়ে দেখা এবং সমাধানসূচক পরামর্শের জন্য বর্ধিত ক্ষমতাসহ ফেমিন কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়। এছাড়াও ১৮৯৬-১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সহ বিহার, বোম্বে, অযোদ্ধা, মধ্যদেশ ও পাঞ্জাব দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়।
বাংলায় এর মূল কারণ ছিল অনাবৃষ্টি। বাজারে খাদ্যের সরবরাহ থাকলেও তা সাধারনের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বহুগুণ বেড়ে গেলেও, সরকারের দিক থেকে তা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ছিল না। ১৮৯৭ সনের ডিসেম্বরে স্যার জে.বি লায়াল-এর নেতৃত্বে একটি ফেমিন কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের পর্যবেক্ষণে জানা যায় যে বিগত ২০ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়লেও কৃষি-শ্রমিক পেশাজীবীদের মজুরি সেই অনুপাতে বাড়ে নি।
পঞ্চাশের মন্বন্তর
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ১৩৫০ সনে এই অঞ্চল আরেকটি দুর্ভিক্ষের কবলে পরে। ১৯৩৮ সাল থেকে একনাগারে ফসলহানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ আরও কিছু আনুষঙ্গিক ঘটনার কারণে বাংলার মানুষ দুর্ভিক্ষে পতিত হয়। খাদ্যশস্য আমদানি বন্ধ, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন, সরকারের ব্যর্থতা ইত্যাদি সব মিলিয়ে বাংলার সার্বিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। এই দুর্ভিক্ষে ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ না খেয়ে মারা যায়। সমগ্র বাংলাদেশেই এই দুর্ভিক্ষ আঘাত হানে। এই দুর্ভিক্ষ পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ
সর্বশেষ ১৯৭৪ সাল, স্বাধীন বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। ১৯৭৪ সালে সারা পৃথিবীতে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলেও বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কারণ খাদ্য ঘাটতি ছিলনা। বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ ছিল আকস্মিক দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, দুর্বল খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা, যুদ্ধ পরবর্তী রুপান্তর অবস্থা, বিধ্বস্ত অর্থনীতি, প্রত্যাগত শরণার্থীর পুনর্বাসন, মুদ্রাস্ফিতি, মাথাপিছু আয় ক্রমান্বয়ে হ্রাস, ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে ৭১-এ পরাজিত শক্তি। শুধু তাই নয়, এদের কারসাজিতে বাংলাদেশগামী খাদ্যের জাহাজ মাঝ পথ থেকে ফেরত যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।