Home লাইফস্টাইল মাতৃত্বকালীন কার্ডিওমায়োপ্যাথি

মাতৃত্বকালীন কার্ডিওমায়োপ্যাথি

দখিনের সময় ডেস্ক:
মাতৃত্বকালীন কার্ডিওমায়োপ্যাথি
মাত্র ২৫ বছর বয়স তার। ফুটফুটে সহজ সরল নির্দোষ মুখশ্রী। শ্বাসকষ্ট নিয়েই চেম্বারে ঢুকল। মাত্র ছয় দিন আগে সিজারিয়ান অপারেশন করে প্রথম বাচ্চার মা হয়েছে সে। তার মায়ের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল গর্ভাবস্থার শেষদিকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসায় উন্নতি হওয়ায় ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। শারীরিক পরীক্ষায় দেখা গেল পায়ে পানি, দ্রুত হার্ট বিট, রক্তচাপ খুব কম। আমি তাকে দ্রুত সিসিইউতে ভর্তি হতে বললাম। বেডসাইড ইকো করে দেখা গেল তার হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা খুবই কম, মাত্র ২৫ ভাগ। প্রেসার বাড়ানোর জন্য ইনজেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটি হলো পেরিপার্টাম কার্ডিওমায়োপ্যাথি। প্রতি এক হাজার প্রেগন্যান্সিতে একজন এ রোগে আক্রান্ত হন। প্রেগন্যান্সির শেষ মাস এবং বাচ্চা প্রসবের পরবর্তী পাঁচ মাস পর্যন্ত এ রোগ হতে পারে।
সমস্যা কোথায় : হার্ট হলো শরীরের কেন্দ্রীয় সেচ মেশিন বা পাম্পিং অরগান। সমস্ত শরীরে অক্সিজেন ও খাদ্য পৌঁছে দেওয়াই তার কাজ। পাশাপাশি সমস্ত শরীর থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বয়ে নিয়ে ফুসফুসে পৌঁছে দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজগুলো করতে হার্টের দরকার শক্তিশালী এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মাংসপেশি। এ মাংসপেশি অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্তকে শক্তি প্রয়োগ করে সারা শরীরে পৌঁছে দেয় এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা পালন করে। কার্ডিওমায়োপ্যাথি রোগে ঠিক এ মাংসপেশিগুলো আক্রান্ত হয়। মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পাম্পিং ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে প্রেসার কমে যায়। রোগী সহজে হাঁপিয়ে ওঠে, কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, শ্বাসকষ্ট হয়, স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়।
রোগের কারণ কী : রোগের কারণ জানা থাকলে চিকিৎসা যথার্থ এবং সহজ হয়। যেমন- যক্ষ্মার যখন কোনো কারণ জানা ছিল না তখন উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা: যেমন- হাওয়া বদল করা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি উপদেশ দেওয়া হতো। তবে সব রোগীই আগে-পরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। কিন্তু যখন জানা গেল যে, যক্ষ্মা একটি জীবাণুর সংক্রমণের কারণে হয় তখন বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগে গেলেন এর জীবাণুনাশক ওষুধ আবিষ্কারে। আমরা এখন জানি যে, সঠিক চিকিৎসা পেলে যক্ষ্মা আরোগ্যযোগ্য রোগ। কিন্তু পেরিপার্টাম কার্ডিওমায়োপ্যাথির সঠিক কারণটি আমরা এখনো জানি না। নানান তত্ত্ব এবং মতামত অবশ্য আছে। তবে এখনো কোনোটির চূড়ান্ত সুরাহা হয়নি। কোনো কোনো তত্ত্ব অনুযায়ী বাচ্চা গর্ভাশয়ে থাকাকালীন বাচ্চার দেহের বিরুদ্ধে মায়ের রক্তে এক ধরনের বিষাক্ত কেমিক্যাল বা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এ কেমিক্যাল বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করতে পারে না এবং তার কোনো ক্ষতিও করে না। কিন্তু তা মায়ের হার্টকে টার্গেট করে এবং হার্টের মাংসপেশির প্রদাহ সৃষ্টি করে মাংসপেশিগুলোকে দুর্বল করে দেয়। এ তত্ত্বের সঙ্গে বাতজ্বর থেকে হার্টের ভাল্ব নষ্ট হওয়ার বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার মিল রয়েছে।
চিকিৎসা কী : এখানে মনে রাখা দরকার, হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি দুর্বল হওয়ার আরও কারণ রয়েছে। যেমন হার্টের নিজস্ব রক্তনালিতে চর্বি জমে বা ব্লক হয়ে মাংসপেশি ধ্বংস হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগ ও রিং বা বাইপাস অপারেশনের মাধ্যমে ব্লক অপসারণ করে চিকিৎসা দিলে হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। হার্টের ভাল্ব নষ্ট হয়েও হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। সেক্ষেত্রে বেলুন করে বা অপারেশনের মাধ্যমে ভাল্ব প্রতিস্থাপন করে চিকিৎসা করলে পাম্পিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বিভিন্ন জীবাণুর আক্রমণেও তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি হয়ে মাংসপেশি দুর্বল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু মাতৃত্বকালীন কার্ডিওমায়োপ্যাথির ক্ষেত্রে চিকিৎসা কী হবে? এর তো কোনো সুনির্দিষ্ট কারণই জানা নেই এখন পর্যন্ত।
তাই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাই এখন পর্যন্ত ভরসা : ১। রোগীর শারীরিক বিশ্রাম খুবই জরুরি। ২। প্রেসার কমে গেলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে প্রেসার বাড়ানোর ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। ৩। তরল বা লিকুইড গ্রহণ কমিয়ে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ৪। শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত পানি ডাইউরেটিকসের মাধ্যমে বের করে দিতে হবে। ৫। প্রেসার মোটামুটি বজায় থাকলে RAAS Blockers ,MR Blockers জাতীয় ওষুধ দিলে পাম্পিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ৬। নতুন ওষুধ vabradine, ARNI ইত্যাদি প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। ৭। Digoxin প্রয়োগে রোগীর উপসর্গভিত্তিক উন্নতি হতে পারে। ৮। যেসব রোগীর পাম্পিং ক্ষমতা খুব কম তাদের শিরায় রক্ত জমাট বাঁধতে পারে বা ব্রেন স্ট্রোক করতে পারে। রক্তজমাট বিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।
কোনো স্থায়ী সমাধান : মাতৃত্বকালীন কার্ডিওমায়োপ্যাথির এক-তৃতীয়াংশ রোগী সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়। সুতরাং তাদের প্রাথমিক সাপোর্টিভ চিকিৎসাটা নিশ্চিত করতে হবে। অন্য এক-তৃতীয়াংশ রোগী দীর্ঘস্থায়ী হার্ট ফেইলুরে চলে যায়। ভালো হয়, খারাপ হয় এভাবে চলতে থাকে। যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ ভালো থাকার পূর্বশর্ত। বাকি একতৃতীয়াংশ রোগীর জন্য দুঃসংবাদ! এরা দ্রুত খারাপ হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে। চিকিৎসা দেওয়া সত্ত্বেও উপসর্গ শুরুর ছয় মাসের মধ্যে যথেষ্ট উন্নতি না হলে বুঝতে হবে এরা এ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। তাদের বাঁচনোর একমাত্র উপায় হার্ট প্রতিস্থাপন বা ট্রান্সপ্লান্ট করা। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
লেখক: ডা. মাহবুবর রহমান, সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

কোথাও সরকারিভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি, দেশকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে

দখিনের সময় ডেস্ক: সরকারিভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি জানিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, দেশের পাহাড়ি এলাকাতেও বহুমুখী ষড়যন্ত্র থেমে...

দ্রুত প্রণয়ন করা হবে বিচারক নিয়োগ নীতিমালা: প্রধান বিচারপতি

দখিনের সময় ডেস্ক: প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করা হবে। একই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট আইনও করা হবে বলে...

গায়েবি মামলার কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে: আসিফ নজরুল

দখিনের সময় ডেস্ক: অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বিচার বিভাগ ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিগত...

ইসরায়েলে মশাবাহিত ‘ওয়েস্ট নাইল’ ভাইরাসে নিহত ৭০, আক্রান্ত ৯১৩

দখিনের সময় ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি দেশ লেবানন ও ফিলিস্তিনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইসরায়েল। গাজায় যুদ্ধ শেষ করতে না করতেই, দেশটি নতুনভাবে লেবাননে যুদ্ধ শুরু করেছে। এদিকে, মশাবাহিত...

Recent Comments