Home শীর্ষ খবর “আমার লাশ পেলেও চিনতে পারবি না”

“আমার লাশ পেলেও চিনতে পারবি না”

এরপর এলো বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ। বাবার স্মৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে শেখ রেহানা ফাঁকা দৃষ্টি মেলে বহুদূরের কাউকে বলার মতো কণ্ঠে বললেন, “সেই স্মৃতি কী বলে শেষ করা যায়! বাবা সবাইকে ভালবাসতেন। আমি ছিলাম তাঁর খুব কাছের। প্রতি জন্মদিনে তাঁকে প্রথম ফুলটা আমিই দিতাম। তিনি নিয়মিত মর্নিং ওয়াক করতেন।

আমি তাঁর সাথে অত জোরে জোরে হেঁটে পারতাম না। কিন্তু গেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বাড়ির কাছাকাছি এলে আমি দৌড়ে তাঁর কাছে চলে যেতাম। আমাদের বাসায় বেলী ফুলের গাছ ছিল। আমি মালা গেঁথে আব্বাকে দিতাম। কখনো কখনো বাবার ওপর বিভিন্ন কারণে রাগও করেছি। হয়তো কোথাও যেতে চেয়েছি, তিনি যেতে দেননি। ফলে রাগ করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। বাবা নিজে আদর করে না সাধা পর্যন্ত খাইনি। অবশ্য রাত করে ফেরাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। রেগে গিয়ে বলতাম, পলিটিকস করেন কেন? বাবা বলতেন, তুই এমন কথা বলিস কেন; আমার কাছে তুইও যা সাড়ে সাত কোটি মানুষও তা। এতে আমার রাগ আরো বেড়ে যেত। বলতাম, আমি কারো সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারব না। আজ বুঝি, বাবা আমার থেকে ওই ধরনের বক্তব্য আশা করেননি।”

এখানে এসে শেখ রেহানা আবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। ধরা গলায় বললেন, “আমার এখনো বিশ্বাস হয় না আব্বা নেই। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আব্বা প্রথমে আমাকে বিদেশ যেতে দিতে চাননি। বলেছেন, তুই গিয়ে থাকতে পারবি না, কষ্ট হবে। তখন কেন যে আব্বার কথা শুনলাম না। কপালে দুঃখ ছিল। তা না হলে এক সাথেই যেতে পারতাম। আমরা দু বোন বেঁচে থেকে বুঝতে পারছি, এভাবে বেঁচে থাকার কি অসহনীয় যন্ত্রণা।”

কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে শেখ রেহানা ধীরে ধীরে বলতে থাকলেন: “বাবা জেলে থাকতে প্রতি সপ্তাহে আমি চিঠি লিখতাম। সংসার, রাজনীতির সবকিছুর খবরই আমি তাঁকে দিতাম। সে সময় পত্রিকার রাজনৈতিক খবরের কাটিং রাখতাম। কোনো সপ্তাহে চিঠি লিখতে না পারলে আব্বার চিঠির প্রথম লাইনটি থাকত, মা তুই কি অসুস্থ, চিঠি লিখলি না কেন?”

জাতির পিতা সম্পর্কে ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ নেয়া সাক্ষাৎকারে শেখ রেহানা আরো বলেছিলেন, “আব্বা মানুষকে খুব বিশ্বাস করতেন। পিতা হিসেবে খুবই স্নেহশীল ছিলেন। তিনি চাইতেন, আমরা সারাক্ষণ তাঁর পাশেপাশে থাকি। ঝড়-তুফান হলে সারারাত তিনি ঘুমাতেন না। তসবি নিয়ে সারারাত ছুটাছুটি করতেন। আর বলতেন, আল্লাহ আমার দেশ গরিব, তুমি রহমত করো। আমরা তাঁকে ঘুমাতে বললে বলতেন, তোরা বুঝিস না, আজ কেউ বাঁচবে না। সবার জন্য তাঁর অফুরাণ ভালোবাসা ছিল। আব্বা বাইরে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু ঘরে এসে আমাদের সাথে খেলার সময় শিশুর মতো হয়ে যেতেন। মাঝে মধ্যে ছাদে বসে আব্বার মাথার পাকা চুল বেছে দিতাম। শেষদিকে পাকা চুল বাছার সময় একদিন কি কারণেই যেন মাথার একটি কাটা দাগ দেখিয়ে বললেন, আমার লাশ তো তোরা পাবি না, পেলেও চিনতে পারবি না; এই কাটা দাগ দেখে যদি চিনতে পারিস। তাঁর অই কথা শুনে বুকের ভিতর ধক করে উঠেছিল। ওই ধরনের কথা শুনতে আমার মোটেই ভালো লাগেনি। তাই ও নিয়ে আব্বাকে কোনো দিন কোনো প্রশ্ন করিনি। কেবল বলতাম, এ ধরনের কথা বলবেন না। কিন্তু তাঁর কথাই এভাবে সত্যি হয়ে গেল!”

উল্লেখ্য, ঘটনা প্রায় এ রকমই ঘটে যাচ্ছিল। খুনিরা বঙ্গবন্ধুর কফিন পাল্টে দিয়েছিল। কিন্তু তরুণ পাইলট শমশের আলী লাশ না দেখে বহন করতে চাননি বলে বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। সে সময় বিমান বাহিনীর তরুণ এ পাইলট পরে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। বিমানবাহিনীর উপ-প্রধান হিসেবেই তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে, বিমান বাহিনীর প্রধান আর হতে পারেননি। তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো।

বাবার সঙ্গে শেষ কথা প্রসঙ্গে ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ নেওয়া শেখ রেহানার সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত করি: “আব্বা চাননি আমি বিদেশ যাই। তিনি বলেছিলেন, বাইরে তোর ভালো লাগবে না, কান্নাকাটি করবি; যেয়ে কাজ নেই। তার কথা শুনিনি। কিন্তু বিদেশ গিয়ে দেখলাম আব্বার কথাই হুবহু সত্যি। একটুও ভালো লাগছে না। কিন্তু এ কথা লজ্জায় তাঁকে বলার উপায় ছিল না। তবু কয়েকদিন পর ১৩ আগস্ট টেলিফোনে আব্বাকে বললাম, আমি দেশে আসতে চাই, আমার একদম ভালো লাগছে না। আমার কথা শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, কিরে আগে বলিনি, ঠিক আছে আমি টিকেট পাঠাবার ব্যবস্থা করছি, মন খারাপ করিস না। এই তাঁর সাথে শেষ কথা।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

বিআরইউ’র সভাপতি আনিসুর, সম্পাদক খালিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির (বিআরইউ) সভাপতি আনিসুর রহমান খান স্বপন (নিউ এইজ / ঢাকা ট্রিবিউন) আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন খালিদ সাইফুল্লাহ (নয়া...

চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জল

দখিনের সময় ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের গণপিটুনিতে নিহত মাসুদ কামাল তোফাজ্জলের জানাজা শেষে বরগুনার পাথরঘাটায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে...

অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর গ্রেফতার

দখিনের সময় ডেস্ক: চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) তাকে আটক করা হয়। নিউমার্কেট থানার...

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ

দখিনের সময় ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম...

Recent Comments